আটকে গেল বিজেপির রথযাত্রা
৭ ডিসেম্বর ২০১৮বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জায়গা থেকে তাদের রথযাত্রা, যার রাজনৈতিক নাম ছিল ‘গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা', তার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল অনেক আগেই৷ কিন্তু চুপ ছিল রাজ্য প্রশাসন৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে আপত্তি উঠল উত্তর বঙ্গের কোচবিহার থেকে৷ প্রশাসন জানাল, এই যাত্রা ঘিরে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে, তাই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না৷
বিজেপি সরাসরি এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করল কলকাতা হাইকোর্টে৷ কিন্তু আদালতও প্রশাসনের উদ্বেগেই সহমত হলো৷ জানিয়ে দিল, কোনো হাঙ্গামা যেহেতু কাম্য নয়, আপাতত স্থগিত থাক রথযাত্রা৷ বিজেপির তরফের আইনজীবী দাবি করেছিলেন, কোনো হাঙ্গামা হবে না৷ কিন্তু আদালত তাতে আশ্বস্ত হতে পারেনি৷ উল্টে মন্তব্য করেছে, যদি হাঙ্গামা হয়, তা হলে কোনো রাজনৈতিক নেতা তার দায় নেবেন না৷ পুরো চাপটাই এসে পড়বে পুলিশ এবং প্রশাসনের ঘাড়ে৷ কাজেই ৯ জানুয়ারি, এই মামলার পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত রথযাত্রা স্থগিত থাক৷
এদিকে বৃহস্পতিবার রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের গাড়ি বহরে হামলা হয়৷ হামলায় বেশ কয়েকজন বিজেপি কর্মী আহত হয়েছেন৷ ক্ষুব্ধ দিলীপ ঘোষ হামলার জন্য তৃণমূলকে দায়ী করেছেন৷ তবে তৃণমূল পুরো বিষয়টিই ‘বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব' বলে দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করেছে৷
আদালতের রায়ে গভীর অস্বস্তিতে বিজেপি৷ এর আগেও কলকাতায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর জনসভা নিয়ে যখন আপত্তি তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার, তখন এই আদালতই ছাড়পত্র দিয়েছিল৷ এই যুক্তিতে যে, সভা-সমিতি, মিছিল ইত্যাদি যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত রাজনৈতিক অধিকার৷ তাতে আপত্তি করা যায় না৷
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার, সেই যুক্তিতেই তাঁদের এবারের কর্মসূচিও বৈধতা পাবে বলে তিনি আশা করেছিলেন৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, বিশেষত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের আশঙ্কাকে যে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে, সেটা তাঁরা আশা করেননি৷
যদিও তারপরও দিলীপ ঘোষ জোর গলায় বলেছিলেন, পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী অমিত শাহ কোচবিহার আসবেন এবং সভা করবেন৷ কিন্তু জানা যায়, অমিত শাহ নিজে অত্যন্ত বিরক্ত, দলের রাজ্য নেতৃত্বের এই ব্যর্থতায়৷ রাজ্য প্রশাসনের দিক থেকে এমন আপত্তি উঠতে পারে, এটা ভেবে রেখে কেন আইনি বিষয়গুলি আগেই সুরক্ষিত করে নেওয়া হয়নি, সেই জবাবদিহি তিনি চেয়েছেন৷ এবং জানিয়ে দিয়েছেন, রথযাত্রা না হলে তিনি আসছেন না৷
রাজ্য বিজেপি তা-ও শেষ চেষ্টা করেছিল শুক্রবার সকালে আদালত খোলার পর ফের একদফা শুনানির৷ কিন্তু জানা যায়, এদিন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত ব্যক্তিগত কারণে ছুটিতে আছেন৷ তাঁর পরই যিনি সিনিয়র বিচারপতি, তাঁর এজলাসে যদি শুনানি হয়ও, প্রধান বিচারপতির আগের দিন দেওয়া রায় উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই৷
রথযাত্রা এভাবে আটকে যাওয়ায় বিজেপিরই একাংশ কিন্তু ক্ষুব্ধ৷ এঁদের বক্তব্য, প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার রাজনৈতিক স্তরে বিরোধ হওয়াই ঠিক হতো৷ ভুল হয়েছে আদালতে যাওয়া৷ আর আরো একটি অংশ, যার মধ্যে আছেন রাজ্যের দায়িত্বে থাকা বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মুকুল রায়, তাঁদের মতে, রথযাত্রার কর্মসূচি নেওয়াটাই ভুল ছিল৷
পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশে রথযাত্রা শব্দটাই অন্য অর্থ বহন করে, যা সেই বাবরি মসজিদ ভাঙার অনুষঙ্গ ফিরিয়ে আনবে৷ সম্ভবত সেই কারণেই বিজেপির বাঙালি নেতৃত্বের একাংশ একে রথযাত্রা না বলে গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা বলাও সঠিক মনে করেছিল৷
কিন্তু শেষরক্ষা হলো না৷ এবং স্মৃতিচারণও আটকে থাকছে না৷ আলোচনায় বারবার উঠে আসছে সেই প্রসঙ্গ, যখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদের সরকার আটকে দিয়েছিল লালকৃষ্ণ আদবানির রথ৷ সোশাল মিডিয়ায় ঘুরেফিরে আসছে লালুর সেই অজেয় মন্তব্য— ‘‘সরকার না চাহি, তো দাঙ্গা না হোয়ি!'' সরকার না চাইলে কখনো দাঙ্গা হয় না!