1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘‌নরম ধর্মনিরপেক্ষতায় হবে না!'

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
২৪ জুলাই ২০১৮

বিজেপির তাত্ত্বিক সংগঠন আরএসএস যেভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রচার করে, তার মোকাবিলা করতে গেলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারকেও শক্তিশালী হতে হবে৷ বলছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শোভনলাল দত্ত গুপ্ত৷

https://p.dw.com/p/31rj2
Indien Hindu-Nationalisten Protest
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Sarkar

ডয়চে ভেলে:‌ সমাজতাত্ত্বিকেরা, যাঁরা সমাজের পর্যবেক্ষক, তাঁরা একটা কথা বলেন — এই যে র‌্যাডিকাল ন্যাশানালিজম, এই যে উগ্র জাতীয়তাবাদ, যার আড়ালে এক ধরনের মৌলবাদও সক্রিয়, এটা চিরকালই ভারতে ছিল, উপমহাদেশে ছিল৷ আপনিও কি তাই মনে করেন?‌

শোভনলাল দত্ত গুপ্ত: না, প্রথম কথা হচ্ছে, আমি কিন্তু এই শব্দটার সঙ্গেই একমত নই৷ এই যে র‌্যাডিকাল ন্যাশানালিজম কথাটা বলা হচ্ছে, মানে বর্তমানের যে শাসকগোষ্ঠী, যারা ভারতবর্ষ চালাচ্ছে, তাদের ন্যাশানালিজমকে কিন্তু আমি কখনও র‌্যাডিকাল বলবো না৷ র‌্যাডিকাল শব্দটার মধ্যে একটা অন্য ব্যাঞ্জনা আছে৷ র‌্যাডিকাল বলতে আমরা বুঝি, একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার, যেটা অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে৷ এইটাকে আমি বলবো এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ৷ এক ধরনের রক্ষণশীল, ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট জাতীয়তাবাদ৷ এই প্রবণতা ভারতবর্ষে চিরকালই ছিল বলতে, স্বাধীনতার আন্দোলনের সময়, এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য ছিল৷ নেহেরু যার প্রতিনিধি ছিলেন, বা সুভাষ বোস, এঁরা বরাবরই খুব ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন৷ কিন্তু অন্য প্রবণতা খানিকটা (‌বাল গঙ্গাধর)‌ তিলকের মধ্যে ছিল, খানিকটা অরবিন্দর মধ্যে ছিল, কিছুটা গান্ধীর মধ্যে ছিল৷ ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ৷

এই যে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ, এটারই চল ছিল৷ তা হলে হঠাৎ এমন কী বদল ঘটল সাধারণের পর্যায়ে, এমন কোনো গোপন রাগ, বা অ্যাজেন্ডা ছিল যে পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলাতে শুরু করল?‌

ShovonlalDattagupta - MP3-Stereo

এই বদলের আমি দু'টো কারণ বলবো৷ ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে একটা পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নেহেরুর আমলে৷ তিনি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন এবং খুব জোর দিয়ে প্রচার করতেন৷ কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষতার যেভাবে জোরদার প্রচার করার, তুলে ধরার দরকার ছিল, সেটা আমরা চেষ্টা করিনি৷ তার বদলে ছিল একটা নরম-সরম, প্রচ্ছন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা৷ এটা একটা কারণ৷ কীরকম প্রচ্ছন্ন ধর্ম নিরপেক্ষতা?‌ ধরুন, কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীরা, মায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, নানান হিন্দু ধর্মীয় আচার-বিচার মেনে চলছেন৷ এইগুলো যদি তাঁরা সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতেন, তা হলে অবস্থা আজ এতটা খারাপ হতো না৷ আমরা যদি দেখি যে নেতা-নেত্রীরা মন্দিরে যাচ্ছেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন, তাহলে একটা ভুল বার্তা যায় হিন্দুদের কাছে, যে এরা ধর্মনিরপেক্ষ হোক আর যা-ই হোক, এরা আসলে হিন্দুত্বের পক্ষে৷

আর দ্বিতীয় কারণাটা অনেক গভীরের৷ আমাদের ভারতবর্ষে মানুষ এখনও যেভাবে জাত, পাত, ধর্মে ভাগ হয়ে আছে, সেখানে আমাদের মনের গভীরে আমরা কিন্তু ভীষণভাবে নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে সচেতন এবং অন্য ধর্ম সম্পর্কে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন অসহিষ্ণুতা আমাদের মধ্যে আছে৷ এখানে প্রচ্ছন্ন অসহিষ্ণুতা বলতে আমি বলতে চাইছি, অন্য ধর্মের আচার-বিচার, তার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা জানতে চাই না৷ এমন নয় যে, আমরা তার বিরোধিতা করছি৷ এক ধরনের অনিচ্ছাকৃত অসহিষ্ণুতা৷ যেমন ধরুন, আমরা ক'জন ইসলামি সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাই?‌ আমাদের সেসব পড়ানোও হয় না, জানানোও হয় না৷ আমাদের আচার-আচরণেও তার কোনো প্রতিফলন নেই৷ গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম পরিবার পাশাপাশি বাস করছেন, এমন হয়ত হয়৷ তাঁরা যখন সহাবস্থান করছেন, তখন কোনো ঝগড়াঝাটি নেই৷ কিন্তু আমরা খুব সচেতনভাবে আরেকজনের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বোঝা, জানতে চাওয়া, তাঁদের সঙ্গে মেশা, বিয়ে থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক, এগুলো থেকে আমরা এখনো ভীষণরকম দূরে৷

এই দু'টো জিনিস থাকার কারণেই যে, হিন্দুত্ববাদীরা আজকে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এটাকে কাজে লাগাচ্ছে৷ এবং এতদিন যে প্রচ্ছন্ন ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হয়েছে, উলটোদিকে ওরা কিন্তু ততটাই প্রকট এবং জোরদার সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করছে৷ নমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে কিন্তু সেই শক্তপোক্ত সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করা যাবে না৷ একে ঠেকানোর একমাত্র রাস্তা, ইওরোপে যেটা হয়েছে, সচেতনভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বাড়াতে হবে৷ লেখাপড়ার জগতে, সমাজ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে, দৈনন্দিন আচার-বিচারে যুক্তিবাদ, আধুনিকতার সচেতনভাবে প্রসার ঘটাতে হবে৷ এবং একটা সহনশীলতার আবহ গড়তে হবে৷ প্রো-অ্যাক্টিভ টলারেন্স৷ স্বতঃপ্রবৃত্ত সহনশীলতার প্রসার৷ সেটা আমরা কখনো করিনি৷ এর ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে একটা শক্তিশালী এবং প্রো-অ্যাক্টিভ হিন্দু জাতীয়তাবাদ৷

আপনি এই যে সহনশীলতার প্রসারের কথা বলছেন, সংখ্যালঘুদের মূলস্রোতে নিয়ে আসার কথা বলছেন, এর জন্যে যে ন্যুনতম শিক্ষার দরকা হয়, সেটা আজকে ভয়ংকরভাবে অনুপস্থিত৷ আজকে এই হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারের যুগে, যে যা পারছে ভুয়া তথ্য চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ এই ক্ষেত্রে কী মনে হয়, আমরা কতটা অসহায়?‌ কতটা বিপদ আমাদের?‌সে তো বটেই৷ এটা আমাদের একটা সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হওয়া উচিত ছিল, যে কারণে এটাকে আমি শুরুতেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বলেছি, এই যে শেখানো হয়েছে যে, হিন্দুরাই সমাজে সব, মুসলমানেরা কেউ নয়, এমনকি তাঁরা ভারতীয়ই নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ নয় — এই ব্যাপারটা আমাদের মাথায় যে ঢোকাতে পারছে, তার কারণ, আমরা সত্যি সত্যিই তো তাঁদের খোঁজ রাখিনি৷ আমি যদি আরেকটু গভীরে যাই, ধরুন, আপনি বাঙালি, আমিও বাঙালি৷ আমরা পাশের রাজ্য ওড়িশার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে কতটা খোঁজ রাখি?‌ বা একইভাবে একজন গুজরাটি, সে বাঙালি সংস্কৃতি, বা অসমীয়া সংস্কৃতি সম্পর্কে কতটা জানে? এই কাজটা খুব শক্ত৷ ছোটবেলা থেকে, একেবারে স্কুলপাঠ্য থেকে এগুলো যদি জানানো না হয়, এটাকে যদি একটা সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হিসেবে না নেওয়া হয়, তাহলে সমস্যা৷ এখানে আমি বলবো, একটা কাজ দক্ষিণপন্থিরা করতে পেরেছে, যেখানে বামপন্থিরা ব্যর্থ হয়েছে,‌ কংগ্রেসও ব্যর্থ হয়েছে৷ সেখানে বিজেপির যে সাংস্কৃতিক শাখা আরএসএস, তারা কিন্তু এই কাজটা খুব ভালোভাবে করে৷ পাড়ায় পাড়ায় তাদের শাখার মাধ্যমে, স্কুলগুলোর মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই যে বিষবাষ্প তারা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তার পাল্টা কর্মসূচি বামপন্থিরা নিতে পারেনি৷ তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়েই খুশি থেকেছে৷ খুব সংগঠিতভাবে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজটা হয়নি৷ যেটুকু হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে, বইপত্তরে কিছু কিছু পড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু এটাকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে নেওয়ার যে দরকার ছিল, জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস সেটা করেনি, বামপন্থিরা হয়ত বিচ্ছিন্নভাবে করেছে, কিন্তু তাদেরও কোনো সুসংহত কর্মসূচি ছিল না৷ আরএসএস সেই জায়গায় কাজটা শুরু থেকেই করেছে এবং এখন তার সুফল পাচ্ছে৷

আপনি কি শোভনলাল দত্ত গুপ্তের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য