পশ্চিমবঙ্গে ‘রাজনৈতিক’ রামনবমী
৫ এপ্রিল ২০১৭ধর্মীয় উৎসব বাংলায় নতুন কিছু নয়৷ এবং সেই উৎসব পালনের আধিক্যও প্রতি বছরই বাড়ছে৷ অনেক নতুন উৎসব যুক্ত হচ্ছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বনের ক্যালেন্ডারে৷ কিন্তু এবার এমন এক উৎসবের সংযোজন হলো, যার পিছনের উদ্যোগ এবং উদ্দেশ্য সন্দেহজনক৷ বিজেপি রাজনৈতিক দল হিসেবে সরাসরি না থাকলেও তাদের প্রত্যক্ষ মদতে এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’, ’বজরং দল’ ও স্থানীয় ‘হিন্দু সংহতি মঞ্চ’-এর উদ্যোগে কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পালিত হলো ‘রামনবমী’৷ রাস্তায় মিছিল হলো রামভক্তদের, অনেক জায়গায় অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে৷ এবং অভিযোগ, অনেক মিছিলেরই যাত্রাপথ ছিল মুসলিম-প্রধান এলাকা দিয়ে৷ এ কারণে শঙ্কিত রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ মহল৷
হঠাৎ রামনবমী পালনের এত তোড়জোড় কেন, সে নিয়ে সন্দিগ্ধ অনেকেই৷ কারণ, রামনবমী মূলত উত্তর ভারতের উৎসব৷ বাংলায় এর প্রচলন থাকলেও কখনোই তার উদযাপন এমন গণ হারে ছিল না৷
যদিও কিছুটা বিস্ময়জনক যে রামনবমী পালনের এই উদ্যোগে বাংলার সাধারণ মানুষের, হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বেশ ভালো সাড়া মিলেছে৷ এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ৷ একাধিক জেলায় তলোয়ার, হাঁসুয়া, টাঙ্গি, কাটারি নিয়ে মিছিল হয়৷ ঘন ঘন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ওঠে মিছিল থেকে৷ এছাড়াও একাধিক জেলায় হয় যাগযজ্ঞ, পূজা-অর্চনা৷ খাস শহর কলকাতার ভবানীপুরে হয় অস্ত্র মিছিল! বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় কলকাতার বিভিন্ন এলাকায়৷ যাঁরা এই কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নেননি, তাঁদেরও অনেকের প্রতিক্রিয়া – হিন্দু অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে এই ধরনের উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে৷ এমনকি যাঁরা আপাত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, তাঁদেরও অনেকে বলছেন, মহরমের মিছিল যদি হতে পারে, তা হলে রামনবমীর মিছিল হলে আপত্তি কোথায়!
সম্ভবত সেই গণ মানসিকতার আঁচ পেয়েই রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সতর্ক৷ প্রথমত, রামনবমীর এই উদযাপনের বিরোধিতা কেউ করছে না৷ তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ বেশ কিছু জেলায়, বিশেষত বীরভূমে হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়েছে সমান উৎসাহে৷ কিন্তু তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতাই বলেছেন, আমন্ত্রণ পেলে তাঁরা রামনবমীর মিছিলেও যোগ দেবেন৷ তৃণমূল নেত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, রাম চিরকালই ঘরে ঘরে পুজো পেয়ে এসেছেন৷ তার জন্য তাঁকে দাঙ্গা করতে হয়নি৷ পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য পর্যন্ত তাঁর মন্তব্যে তথাকথিত রামরাজত্বের প্রসঙ্গ তুলেছেন, যে রামরাজত্ব, প্রদীপবাবুর মতে আদতে সুশাসন৷ অর্থাৎ নেতাদের কেউই এই রামনবমীর রাজনীতির পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠের যে ধর্মীয় বোধ, তাকে অস্বীকার করতে পারছেন না৷
এই অবস্থায় যারা অন্তত তাত্ত্বিক বিরোধিতার জমি তৈরির চেষ্টা করতে পারত, সেই বামেরাও একই রকম নিশ্চেষ্ট৷ সিপিএম নেতা, প্রাক্তন সাংসদ সুজন চক্রবর্তি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, এই রামনবমী পালনের উদ্যোগ আসল সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র৷ অন্যদিকে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে অন্য একটা পুজো দিয়ে এর বিরোধিতা করছে, সেটাও ঠিক নয় বলে সুজনবাবুর অভিমত৷ কিন্তু তাঁরা, বামেরাও এখনই কিছু করছেন না৷ বরং পরিস্থিতির ওপর আপাতত নজর রেখে চলাই শ্রেয় মনে করছেন৷
গবেষক-প্রাবন্ধিক সুস্নাত চৌধুরি যেমন মনে করছেন, আর পাঁচটা ধর্মীয় উৎসবের মতো যদি রামনবমীও হয়, তাহলে ক্ষতি কী! সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি শ্লেষের সঙ্গে লিখেছেন, ‘‘তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি যত হিন্দুত্ববাদী, বিজেপি/আরএসএস সমর্থকদের হ্যাটা করবে, তাদের 'চাড্ডি' বলবে, শিক্ষা নিয়ে কর্মস্থলের ডেজিগনেশন নিয়ে খোঁটা দেবে, তাদের পোস্টের বানান-ভুল দেখিয়ে অন্য কম্বিনেশনে আরেকরকম ভুল বাংলা বানানেই পোস্ট করবে....তত জনবিচ্ছিন্ন হবে৷ হবেই৷ হচ্ছেও৷ ওই হিন্দুত্ববাদীরাও তত শক্তিশালী হবে৷ হচ্ছে৷ ঠিক হচ্ছে৷ আমাদের এটাই প্রাপ্য ছিল৷’’
আর ডয়চে ভেলেকে সুস্নাত জানালেন, নিজের উদ্বেগের কথা৷ বললেন, কলকাতা শহরেই রামনবমীর মিছিল যে রাস্তা ধরে যাবে, বা সেই সব মিছিল যেখানে গিয়ে শেষ হবে, প্রায় সবই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা৷ কাজেই এই উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য কী, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার থাকা নয়৷ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী রাজ্যবাসীকে ঠিক সেটাই দুশ্চিন্তায় রাখছে৷