ভারতে বিরোধী ঐক্যের ছবি
২০ জানুয়ারি ২০১৯উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু, পুবে অরুণাচল থেকে পশ্চিমে গুজরাট, সারা দেশ থেকে আসা বিজেপিবিরোধী দলগুলির নেতাদের হাতে হাত৷ মুখে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আসন্ন লোকসভা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করার শপথ৷
সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সরকারের বিকল্প যে ফেডারেল ফ্রন্টের কথা বলে আসছেন বিরোধী নেতারা, তার চেহারা কী হতে পারে, সেটাই দেখা গেল শনিবার ব্রিগেড সমাবেশে৷ দেখা গেল এক বিরোধী ঐক্যের ছবি৷ যখনই এই বিরোধী জোটের কথা উঠেছে, বিজেপি নেতাদের প্রিয় কটাক্ষ হচ্ছে— ওঁরা ঠিকই করতে পারবেন না, ওঁদের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন! কারণ, ওঁরা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন৷
বস্তুত ব্রিগেডের সভার আগে এই কটাক্ষ নানা চেহারায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো সোশাল মিডিয়ায়৷ তার জবাব দেওয়া হলো ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চ থেকেই৷ উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব বিজেপির উদ্দেশে পাল্টা মন্তব্য করলেন, ‘‘একেবারে ঠিক বলেছেন৷ আমাদের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটা ঠিক করা নেই৷ কারণ, জনতা যাঁকে চাইবে তিনিই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী৷''
পাশাপাশি মমতা ব্যানার্জি ও অন্য বিরোধী নেতারাও সবাই একবাক্যে বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটা পরে ঠিক হবে৷ এখন দরকার বিরোধী ভোট এক জায়গায় রাখা৷ কোনোভাবেই যেন বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ না হয়ে যায়৷ এবং সেই প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির ফর্মুলাতেই সায় দিয়েছেন সব বিরোধী নেতা যে, একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হবে৷ যে দল যেখানে শক্তিশালী, তারাই বিজেপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে এবং বাকি দলগুলি সেই প্রার্থীকেই সমর্থন জোগাবে৷
তবে অখিলেশ যাদব যা বলেছেন, অর্থাৎ জনতা যাকে চাইবে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার মধ্যেও সম্ভবত ভবিষ্যৎ ফর্মুলা লুকিয়ে আছে৷ বিরোধী জোটের যে দল সবথেকে বেশি সংসদীয় আসনে জিতবে, সেই দলের নেতাকেই সর্বসম্মতভাবে হয়ত প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে৷ কদিন আগেই যে কথাটা বলেছেন উত্তরপ্রদেশের আরেক নেত্রী, বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতী যে, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটা উত্তরপ্রদেশই ঠিক করে দেবে, যেহেতু এই রাজ্যেই সবথেকে বেশি লোকসভা আসন৷
দিল্লিতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে বিরোধী জোটের উদ্যোগ, সেই জোটে ওই একটি কারণেই মায়াবতী এবং অখিলেশের দল থাকেনি, আলাদা জোট গড়েছে৷ কারণ, এর আগে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে অখিলেশ-মায়বতীর সপা-বসপা জোটের সম্মিলিত দাপটের মুখে হারতে হারতে বেঁচে গেছে বিজেপি৷ এবং দলিত ভোটে বলীয়ান মায়াবতী নিঃসন্দেহে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন৷ কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে গিয়ে তিনি সেই স্বপ্ন হাতছাড়া করতে নারাজ৷
ফলে মায়াবতী কলকাতায় মমতার ব্রিগেড সমাবেশে আসেননি৷ কিন্তু যাঁরা শেষ পর্যন্ত এলেন, তাঁদের তালিকা দীর্ঘ৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী গরহাজির থেকেও বার্তা পাঠিয়েছিলেন সমাবেশ এবং বিরোধী ঐক্যের সাফল্য কামনা করে৷ সোনিয়া গান্ধীর থেকে শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে সভায় ছিলেন কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে৷ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসের মনোনীত রাজ্যসভা সদস্য এবং দলের অন্যতম মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি৷ সবাই মিলে একটি বার্তাই দিলেন যে, এই বিরোধী জোটে কংগ্রেস পুরোমাত্রাই আছে৷ এছাড়া ছিলেন প্রায় সবকটি বিরোধী দলের নেতা৷
কর্ণাটক থেকে এসেছিলেন সেকুলার জনতা দলের নেতা এবং দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া ও তাঁর পুত্র, কর্ণাটকের জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী৷ এসেছিলেন তামিলনাড়ুর ডিএমকে দলের প্রধান, সে রাজ্যের অবিসংবাদী নেতা প্রয়াত করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিন৷ ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, তেলুগু দেশম দলের নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু, যিনি এখন দক্ষিণ ভারতে বিজেপিবিরোধী রাজনীতির অন্যতম মুখ৷
জম্মু-কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ন্যাশানাল কনফারেন্সের নেতা, পিতা-পুত্র ফারুক এবং ওমর আবদুল্লা৷ মহারাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন হেভিওয়েট নেতা, মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের শরদ পাওয়ার৷ এসেছিলেন লোকতান্ত্রিক জনতা দলের নেতা শারদ যাদব, রাষ্ট্রীয় লোক দলের নেতা অজিত সিং, বিজেপি ছেড়ে আসা হেভিওয়েট নেতা যশবন্ত সিনহা, আরেক বিজেপিত্যাগী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরি৷
অরুণাচল প্রদেশ থেকে এসেছিলেন সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গেগং আপাং৷ এদের সঙ্গে ছিলেন দিল্লির নবীন মুখ্যমন্ত্রী, আমজনতা পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বিহারের সংযুক্ত জনতা দলের নবীন নেতা, লালুপ্রসাদ-পুত্র তেজস্বী যাদব এবং এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির দুই তরুণ তুর্কি, গুজরাটের হার্দিক প্যাটেল এবং জিগনেশ মেবানি৷
সম্মিলিত এই বিরোধী ঐক্যের মুখে নরেন্দ্র মোদী যতটা নার্ভাস হওয়া উচিত, ততটাই হয়েছেন৷ শনিবারই গুজরাটে এক অনুষ্ঠানে কলকাতার সমাবেশকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছি, তাই ওরা আমার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে!!'' এদিন ব্রিগেড সমাবেশ থেকেও বিরোধী নেতারা বলেছেন, এরপরই মোদী দুর্নীতির নানান অভিযোগ এনে সিবিআই, ইডি-কে দিয়ে বিরোধীদের বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবে৷ কিন্তু তাতে বিরোধীরা দমছে না৷ মোদী সরকার উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে৷