মমতার বিজেপিবিরোধিতা লোক দেখানো?
৯ মে ২০১৮প্রস্তাবিত বিজেপি-বিরোধী ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার কাজ ত্বরান্বিত করতে গত মার্চে দিল্লি এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি বা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সেবার কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, এনসিপি প্রধান শারদ পাওয়ার-সহ বিভিন্ন বিরোধী নেতা-নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি৷ বৈঠক করেছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের সঙ্গে৷ টেলিফোনে তিনি কথা বলেছেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এবং তামিলনাড়ুর বিরোধী নেতা এম কে স্ট্যালিনের সঙ্গে৷
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের ফুলপুর ও গোরখপুরের কেন্দ্রে নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় পরাজয় সবার চোখ খুলে দিয়েছে৷ এমন একটা সময় তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ফেডারেল ফ্রন্টের তত্ত্ব আওড়াচ্ছেন৷ ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এমন ফ্রন্টের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়৷
এতসবের মধ্যেই একটি অভিযোগ উঠেছে মমতার বিরুদ্ধে৷ তা হলো, তিনি গোপনে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে কাজ করে চলেছেন৷ এই অভিযোগ নিয়ে সন্দেহ আরও মাথাচাড়া দিয়েছে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফরকে ঘিরে৷ দেশজুড়ে মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনে মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে কমিটি গড়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ গত ১ মে বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে কমিটির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
বৈঠকের পর ‘রাজ্যের দাবিদাওয়া' নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ পরে রাত ১০টা নাগাদ রেল ও কয়লা মন্ত্রী (প্রথম সারির বিজেপি নেতা) পীযূষ গোয়েলের বড়িতে গিয়ে বৈঠক করেছেন৷
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি মমতার বিরুদ্ধে গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ তুলেছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে সাধ্বীর ভূমিকা পালন করছেন৷ আর বাংলায় তিনি অত্যাচারী শাসকের ভূমিকা পালন করছেন৷ দিল্লিতে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন, তিনি মা-মাটি-মানুষের সরকার চালাচ্ছেন৷ কিন্তু আসলে বাংলায় উনি দুস্কৃতিদের নেত্রী হিসেবে কাজ করছেন৷ ওঁর নেতৃত্বে সারা বাংলা অস্থির হয়ে উঠেছে৷ মমতা বিরোধী জোটকে দুর্বল করে নরেন্দ্র মোদীকে ২০১৯ সালে বাঁচাবেন৷ বিনিময়ে মোদী সারদা, নারদা-সহ চিটফান্ড দুর্নীতি থেকে মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতাদের বাঁচাবেন৷ এটাই তো ওঁদের গোপন চুক্তি৷''
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে তুমুল অশান্তি চলছে বাংলায়৷ শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে আসন দখলের অভিযোগ৷ অধীরের কথায়, ‘‘আমরা অবাক হয়ে দেখছি, পুলিশ সরাসরি রাজনীতি করছে৷ এতদিন বাংলায পুলিশ শাসকের হুকুম তামিল করত৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হিসেবে কাজ করতে বাঙালি দেখেনি৷ এমনিতে তাছাড়া বাজেটের আগে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসে দেখা করেন৷ তখন তিনি বলেন, তিনি উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত৷ এখন মহাত্মা গান্ধীর জন্মজন্তীর বৈঠকে অন্য বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীরা না এলেও সবার আগে তিনি হাজির৷ কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে বিজেপিরএজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে যখন সন্ত্রাস চলছে, তখন দিল্লির শাসক দলের নেতা, মন্ত্রীরা চুপ করে বসে আছেন৷ দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের কোনো মাথাব্যাথা নেই৷ এ থেকেই তো ‘দুইয়ে দুইয়ে চার' প্রমাণ হয়৷''
মমতার ফেডারেল ফ্রন্টের উদ্যোগকে কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস৷ তাদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ইশারাতেই ফ্রন্টের তোড়জোড় চলছে৷ লক্ষ্য, বিজেপি-বিরোধী ভোটে থাবা বসানো৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তেলঙ্গানা কংগ্রেসের মুখপাত্র শ্রবণ দাসোজু৷
সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নেতা সুজন চক্রবর্তীও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের দিল্লি যাত্রার পেছনে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলছেন, ‘‘যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি ও তৃণমূল দল যেভাবে চলছে, তার মধ্যে কোনো স্বছতা নেই৷ একবার কংগ্রেসের সঙ্গে পরমুহূর্তেই বিজেপি-র সঙ্গে জোট বেঁধেছে তৃণমূল৷ এমন একটা ভাব দেখানো হচ্ছে যে, তিনিই বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার৷ কিন্তু বাস্তবে মোটেও তা নয়৷ দিল্লিতে কোনো সরকারি বৈঠক ডাকা হলে যখন সবাই যাবেন, তখন মমতা যাবেন না৷ আবার যখন কেউ যাবেন না, তখন উনি যাবেন৷ এর অর্থ কী? উনি মোদীকে বোঝাতে চান, ‘দেখো আমি তোমার সঙ্গে আছি৷'''সুজনের ব্যাখ্যা, ‘‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খুব সচেতন ভাবে ‘কাউকে বুঝতে দেব না' মনোভাব নিয়ে গোপনে বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন৷ গোপনে বিজেপিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে৷ এই দেখুন না, ত্রিপুরায় পুরো কংগ্রেস দলটাকে ভেঙে তৃণমূলে নিয়ে গেল৷ লালনপালন করে তাদের আবার বিজেপি-র ঘরে পৌঁছে দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী৷ এভাবেই বিজেপিকে পেছন থেকে সাহায্য করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে তৃণমূল ও বিজেপি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অবশ্য জানিয়েছেন, মহাত্মা গান্ধীর সার্ধ-শতবর্ষ জন্মজয়ন্তী উদযাপনের বৈঠকের ডাক পেয়এই তিনি দিল্লিতে দৌড়ে এসেছিলেন৷ সেখানে তিনি বাংলার দাবি নিয়েও কথা বলেছেন রাজনাথ সিং ও পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে৷ কয়লা মন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে দেখা করে বীরভূম জেলার দেউচা-পাচামি খনি থেকে কয়লা তোলার ভার পশ্চিমবঙ্গকে দেয়ার ব্যাপারে কথা বলেছেন তিনি৷ মাটির নীচে মজুত ২০০ কোটি টন কয়লা তোলার কাজ এখনও শুরু হয়নি ওই খনিতে৷
তবে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের কাজই হলো সমালোচনা করা এবং অভিযোগ করা৷ এক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্যও তাই৷ দলের রাজ্যসভার উপনেতা সুখেন্দুশেখর রায়ের মতে, বাংলায় একের পর এক নির্বাচনে হালে পানি না পেয়ে বিরোধীরা গালগল্প অভিযোগ তুলছে৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস একসঙ্গে হয়েও লড়াই করতে ব্যর্থ হয়ে এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে৷ রাজ্যে অশান্তি ও খুনোখুনির ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে এর আগে সবকটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেক বেশি মানুষকে খুন করা হয়েছে৷ আজ যাঁরা এইসব অভিযোগ করছেন তখন তা জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়৷ এর আগে দিল্লিতে একাধিক সরকারি বৈঠকে হাজির থেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এবার গান্ধীজির জন্মজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন উপলক্ষ্যে এসেছিলেন৷ এ নিয়ে কংগ্রেসের মতো দল যদি অভিযোগ করে, তাহলে তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়৷ আসলে বাংলায় পরাজয় নিশ্চিত জেনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছে বিরোধীরা৷''
এদিকে আগামী ২৫ তারিখ বাংলার বুকে আবারও একই মঞ্চে দেখা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ থাকতে পারেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও৷ বীরভূমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব উপলক্ষ্যে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে তাঁকে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন জানিয়েছেন এই খবর৷