নদী ভাঙন রোধ ও টাকা পানিতে ফেলার গল্প
১ অক্টোবর ২০১৮রাজবাড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান৷ তিনি খোলামেলা কথা বলেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ রাজবাড়িতে পদ্মার ভাঙন রোধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কথা৷ কিন্তু তাতে উঠে আসে ভাঙন রোধে দুর্নীতির কারণ এবং সুযোগের বিষয়৷ তাঁর সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা যায়, বর্ষাকালে নদীর ভাঙন শুরু হলে তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু হয়৷ এছাড়া তীব্র স্রোতের সময় ভাঙন রোধে নদীতে বালুর বস্তা ফেলাই একমাত্র পদ্ধতি বাংলাদেশে৷ যেহেতু তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু হয়, তাই ঠিকাদাররা প্রথমেই বেঁকে বসেন৷ কারণ, বিল পাবেন এক বছর পর৷ পরে অবশ্য অনুরোধে রাজি হয়ে নানা বাহানা শুরু করেন৷ মোটা বালু দেয়ার কথা থাকলেও দেন চিকন বালু৷ মোটা বালুর কথা বললে কাজ বন্ধ করে দেন৷ বলেন, মোটা বালু পেতে অনেক সময় লাগবে৷ তাই তখন চিকন বালু নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না৷ কারণ, ভাঙন মোটা বালুর অপেক্ষায় বসে থাকে না!
এরপর আসে সঠিক ওজনের বিষয়৷ দ্রুত বালুর বস্তা সরবরাহ করার অজুহাতে ব্যাগে বালু কম ভরা হয়৷ সেটা ধরলে তারা বলে তাহলে এত দ্রুত বালুর বস্তা সরবরাহ করা যাবে না৷ আবার জিও ব্যাগ না পাওয়ার অজুহাতে যেনতেন প্রকারে বস্তায় বালু ভরা হয়৷ আর বস্তায় বালু ভরার পর তা বিশেষ পদ্ধতিতে সেলাই করা হয়৷ সেলাইয়ের মেশিন এবং অপারেটর আনা হয় ঢাকা থেকে৷ সেলাইয়ের সুবিধার জন্যও নাকি ওজনের চেয়ে কম বালু ভরতে হয়৷
নিয়ম হলো, একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বালুভর্তি বস্তা পরীক্ষা করে সঠিক হলে বস্তায় লাল রঙের চিহ্ন দেবেন৷ সেই বস্তাই নদীতে ফেলা হয়৷ কিন্তু বস্তা পরীক্ষার জন্য সব সময় ম্যাজিস্ট্রেট এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের পাওয় যায় না৷ পাওয়া গেলেও তারা বেশিক্ষণ থাকেন না৷ কিন্তু ভাঙন তো আর তাদের অপেক্ষায় থাকে না৷ তাই ঠিকাদাররা তাদের ইচ্ছেমতো রেজিস্টারে এন্ট্রি করে বালু ফেলেন৷ তাই যা হওয়ার তাই হয়৷
নদীতে বস্তা ফেলার নৌকাও আসে দূর থেকে৷ সেগুলো আবার বিশেষ ধরনের নৌকা৷ বালু তো নৌকায় তোলা হলো৷ কিন্তু সব বস্তা ফেলা হলো কিনা – তা দেখার জন্য নৌকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোক থাকার কথা থাকলেও প্রায়ই থাকেন না৷ এছাড়া এক নৌকায় কত বস্তা উঠল তার হিসাবও গুনে গুনে নয়, নৌকার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী হিসাব করা হয়৷ কারণ, কাজ তো জরুরি৷ সময় নষ্ট করা যাবে না৷ তাই শিয়ালের কুমিরের ছানা দেখানোর গল্পটি এখানে প্রায়ই খেটে যায়৷
ভাঙন রোধে বালুর বস্তা তৈরি থেকে নদীতে বালু ফেলা পুরো কাজটাই এক প্যাকেজে হয়৷ এ জন্য আলাদা প্রশিক্ষিত শ্রমিক আছে৷ বালু ফেলার জন্য নৌকাও বিশেষ ধরনের৷ আর তা থাকে হাতে গোনা কয়েকজন ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে, পুরোটাই একটা সিন্ডিকেট৷ এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, প্রশাসন সবাই জড়িত৷
একটি জিও ব্যাগে ২৫০ কেজি বালু থাকার কথা৷ তার জন্য সরকারের নির্ধারিত দাম হলো ৪৮০ টাকা ৯ পয়সা৷ এই টাকার মধ্যে বালু ভর্তি বস্তা নদীতে ফেলাও অন্তর্ভূক্ত৷ প্রতিবছর ভাঙনের একেক এলাকায় কয়েক লাখ বালুর বস্তা ফেলা হয়৷
সাধারণত বর্ষা মৌসুম শেষে শুস্ক মৌসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ঠিকাদারকে বিল দেয়ার আগে ওই বস্তা পরীক্ষা করতে যান৷ তখন শতকরা ৩০ ভাগের বেশি বস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না৷ কিন্তু কমপক্ষে ৭০ ভাগ বস্তা থাকার কথা৷ তারপরও ঠিকাদাররা বিল পেয়ে যান৷
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘সত্য কথা হলো, শতভাগ ঠিকমতো কাজ করা সম্ভব নয়৷ নানা সমস্যা আর জটিলতা আছে৷ প্রতিবছর নদী ভাঙন হলেও প্রতিবছরই জরুরি কাজ দেখিয়ে বিনা টেন্ডারে কাজ হয়৷ পরে অফিসিয়াল ফর্মালিটি শেষ করা হয়৷ তবে শুষ্ক মৌশুম হলে আলাদা কথা৷ এ বছর শুষ্ক মৌসুমে ১০ লাখ বালুর বস্তা ফেলার একটি প্রকল্প আছে আমাদের৷ সেখানে আগেই টেন্ডার দিয়ে কাজ হবে৷''
এই প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিবেদক বালু বস্তায় ভরা থেকে নদীতে ফেলার পুরো প্রক্রিয়া দেখা ও বোঝার চেষ্টা করেছে৷ তাতে যেটা স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো: কাজের প্রায় পুরোটাই ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে থাকে৷ নজরদারি বলতে তেমন কিছু নেই৷ আর একই প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর কাজ হচ্ছে৷ সরকারি টাকা পানিতে যায়, অথচ ভাঙন রোধে তেমন কাজে আসে না৷
রাজবাড়ির ভাঙন কবলিত এলাকার রফিক আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘‘বস্তার মধ্যে মোটা বালু দেয়ার কথা, কিন্তু ঠিকাদাররা দিচ্ছেন চিকন বালু৷ মোটা বালু দিলে নদীর মধ্যে যখন বস্তা ফেলতো, তখন তা শক্ত মজবুত হতো৷ কিন্তু চিকন বালু দেয়ার কারণে বালু নদীর পানিতে ভেসে যাবে৷''
মনি সরদার অভিযোগ করে বলেন, ‘‘যে পরিমাণ বস্তা ফেলার কথা, তা ফেলা হচ্ছে না৷ নদীর মধ্যে ট্রলারে করে দূর থেকে বস্তা ফেলে তীরের কাছে এসে শেষ করলে পাড় ঠেকতো৷ কিন্তু অল্প কিছু বস্তা ফেলে ফাঁকি দিয়ে কাজ চলছে৷''
এবারে শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় পদ্মার ভাঙন সবেচেয়ে আলোচিত৷ জুলাই থেকে যে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে এ পর্যন্ত নদীগর্ভে গেছে প্রায় ৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বেশি৷ ভাঙন রোধে এখানে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে৷ এ পর্যন্ত এক লাখ ৬১ হাজার বস্তা ফেলা হয়েছে বলে খবর৷
নড়িয়ার কেদারপুর ইউনিয়নের মুলফতগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী নিশু দেওয়ান৷ তাঁর তিনতলা ভবন নদী গর্ভে চলে গেছে৷ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আমরা জানি, আমাদের এই এলাকায় প্রতিদিন ১০ হাজার বস্তা ফেলার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে অনেক কম বস্তা নদীতে ফেলা হচ্ছে৷ ওজনেও কম দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া মোটা বালু দেয়ার কথা থাকলেও চিকন এবং মোটা বালু মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ আমার মনে হয়, এখানে অবহেলা এবং মনিটরিংয়ের অভাব আছে৷''
শরিতপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার দীর্ঘদিন ধরে নদী ভাঙন কবলিত জেলাগুলোতে কাজ করছেন৷ এখানে যোগদানের আগে তিনি প্রতিবেদনের শুরুতেই উল্লেখ করা রাজবাড়ি জেলায় কর্মরত ছিলেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘এ ধরনের জরুরি কাজে নানা সমস্যা হয়৷ আমরা তা দূর করার চেষ্টা করছি৷ নদীর তীব্র স্রোতে বালুর বস্তা ভেসেও যায়৷ সেখানে তো হিসাবের গড়মিল হতেই পারে৷ তাছাড়া এটা বিশেষ ধরনের কাজ৷ এরজন্য বালু, জিও ব্যাগ, নৌকা সহসাই জোগাড় করা যায় না৷''
তিনি বলেন, ‘‘যাতে ওজন, বালুর মান ও বস্তার সংখ্যা ঠিক থাকে, সেজন্য মনিটরিং বাড়িয়েছি৷ আমাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসন এবং ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন৷ বালুর বস্তা লাল রং দিয়ে মার্কিং করা নিশ্চিত করেছি, যাতে একই বস্তা একাধিকবার কাউন্ট না হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তারপরও জরুরি কাজে অনেক ছাড় দিতে হয়৷ ঠিকাদার পাওয়া যায় না৷ এ কারণে আমরা বালুর বস্তা একবারেই ফাইনাল কাউন্ট করছি৷ শুষ্ক মৌসুমে আবার গুনে ঠিকাদারদের বিল দেয়ার পদ্ধতি বাতিল করেছি৷ কারণ, এই পদ্ধতিতে ঠিকাদাররা কাজ করতে চান না৷''
বালুর বস্তা কম ফেলা, চিকন বালু দেয়া ও ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে বালু পাওয়াই যাচ্ছিল না৷ তাই এ রকম হয়ত হয়েছে৷ এখন আর এই সমস্যা নেই৷''
বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী জনপদই ভাঙনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি৷ এই ভাঙন বর্ষাকালে প্রায় নিয়মিত৷ নদীগুলোর গভীরতাও অনেক বেশি৷ অন্তত ১০০ মিটার৷ গত ৫১ বছরে প্রায় ৬৬৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি জমি বিলীন হয়ে গেছে পদ্মার গর্ভে৷ গেল একশ' বছরে ৭০ কিলোমিটার এলাকা ভেঙে গাইবান্ধা শহরের কাছাকাছি এসেছে ব্রহ্মপুত্র নদ৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কয়েকশ' কোটি টাকা ব্যয় করেও ঠেকানো যায়নি নদী ভাঙন৷ আর সেখানেও একই অভিযোগ- অপরিকল্পিত কাজ, দুর্নীতি৷
নদী বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কিছু এলাকা আছে, যেখানে বছরের পর বছর নদী ভাঙন হচ্ছে৷ সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর, রামগতি, চিলমারী – এসব এলাকায় বছরের পর বছর নদী ভাঙন হচ্ছে, অথচ এর প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না৷ প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে ভাঙন প্রতিরোধের কাজ হয়? বলা হয়ে থাকে টাকা পানিতে ফেলা হয়৷''
তিনি জানান, ‘‘দুই জায়গায় দুর্নীতি হতে পারে৷ আপনি পানির নীচে কী ফেলছেন, সেটা মাপা কঠিন৷ দ্বিতীয়ত, যখন ভাঙন শুরু হয়, তখন তড়িঘড়ি করে ম্যাটেরিয়েলগুলো বানানো হয়৷ তখন আসলে চেক করার সুযোগ তেমন থাকে না৷ শুধু দাম বাড়িয়ে ধরা হয়৷ মান ও পরিমাণ ঠিক রাখা হয় না৷''
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইমামুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আপদকালীন নদী ভাঙন প্রতিরোধে বড় বড় বালুর বস্তা ফেলা হয় নদীতে৷ নদীর তলদেশে যেখানে ভাঙনটা হয় সেখানে এই বালুর বস্তা ফেলে প্রতিরোধ তৈরি করা হয়, যাতে ভাঙন আর এগাতে না পারে৷ স্থায়ী প্রতিরোধের জন্য নদী তীর থেকে তলদেশ পর্যন্ত ঢাল তৈরি করে সেই ঢালে কংক্রিটের ব্লক দেয়া হয়৷ নদীর তীর বাধাই করে দেয়া হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘বালুর বস্তা নদীর গভীরে চলে যায়৷ পানির নীচে যায়৷ ভেসেও যেতে পারে৷ তাই এই সুযোগে এক হাজার বালুর বস্তা ফেলে পাঁচ হাজারের হিসেব দেয়া অস্বাভাবিক কিছু না৷ এটা ব্লকের ক্ষেত্রেও হতে পারে৷ কারণ, ব্লক ফেলার আগে পানির নীচে বালুর বস্তা ফেলতে হয়৷ সেখানে বস্তার হিসাব করা কঠিন৷ তবে এই দুর্নীতির ভাগীদার একমাত্র ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়৷ আমি যতদূর জানি, কিছু পুলিশ, কিছু সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ - সবাই ভাগ বসায়৷ অনেক সময় দুর্নীতি করতেও বাধ্য করা হয়৷ যে সরাসরি দুর্নীতি করে, সে হয়ত শতকরা ১০ ভাগ পায়৷ কিন্তু দুর্নীতি না করলে তার জীবন চলে যেতে পারে৷''
নদী ভাঙন বাংলাদেশে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়৷ প্রতিবছরই বড় বড় নদী তীরবর্তী জনপদে ভাঙনে অনেক এলাকা বিলীন হয়৷ নড়িয়ার ভাঙনেরও আগাম সতর্কতা দিয়েছিল ব্র্যাক৷ তারপরও আগাম প্রস্তুতি না নিয়ে প্রতিবছরই জরুরি ভিত্তিতে বালুর বস্তা ফেলা হয়৷ এর সুযোগে হয় দুর্নীতি৷ ম. ইমামুল হক বলেন, ‘‘প্রতিবছর সরকার এই জরুরি ভাঙন রোধে কোটি কোটি টাকা খরচ করে৷ আর ভঙন শুরু হওয়ার পর বরাদ্দ দিনে দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়৷ যারা বেশি ক্ষমতাশালী, তারা বেশি বরাদ্দ পায়৷ বলা বাহুল্য, এরমধ্যেও লাভের হিসাব আছে৷''