গৃহহীনতা নির্মূলে ব্যর্থ ধনী জার্মানি?
২৪ ডিসেম্বর ২০২৩বার্লিনের টাবর গির্জার দরজা খোলার আধা ঘন্টা আগেই গৃহহীনরা সেখানে পৌঁছাতে শুরু করেন। সপ্তাহে একদিন গির্জাটিতে গৃহহীনদের জন্য একটি ক্যাফে খুলে দেয়া হয়। গৃহহীন মানুষেরা সেখানে বিনামূল্যে খেতে, পান করতে এবং টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন। শিগগিরই এখানে গরম খাবারও দেয়ার আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
বার্লিনের শীতের রাতে তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সপ্তাহে একদিন গির্জার ভেতরে গৃহহীনদের ঘুমাতেও দেয়া হয়৷ ৪০ জনের মতো গৃহহীন এখানে বিছানায় ঘুমাতে পারেন। কখনও কখনও এই সংখ্যা ৬০ জনের বেশি হয়। দুজন স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার তাদের নানা অসুস্থতার চিকিৎসাসেবাও দিয়ে থাকেন।
টাবর চার্চের যাজক সাবিনে আলব্রেশ্ট বলেন, যারা ঘুমানোর জায়গা খুঁজতে আসে আর যারা ক্যাফেতে ঘনঘন আসেন, তারা এক নন।
তিনি বলেন, "সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যারা নন, তারা এখানে আসতে পারেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুবই করুণ অবস্থায় রয়েছেন।"
'গুরুতর সামাজিক সমস্যা'
যারা ঘুমানোর জায়গা খোঁজেন, তাদের অনেকেই পূর্ব ইউরোপ থেকে এসেছেন। তারা হয় বেকার বা কাজের নিশ্চয়তা নেই। অনেকেরই মাদকাসক্তির সমস্যা রয়েছে, সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন।
আলব্রেশ্ট বলেন, একজন ব্যক্তি ‘‘এখানে ২০ বছর ধরে ঘুমাচ্ছেন।''
কিভাবে তিনি এত দুঃখ মোকাবিলা করেন? আলব্রেশ্ট বলেন, ‘‘হেল্পার সিন্ড্রোম (কাউকে সাহায্য করছি, এমন মানসিকতা) কোন উপকার করে না। আপনাকে কঠোর হতে হবে এবং ঘটনাগুলো ব্যক্তিগতভাবে নিলে হবে না।''
এর অর্থ হলো, আক্রমণাত্মক এবং অভদ্র হতে পারে, এমন মানুষকেও সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মার্গট মোসার ৩০ বছর আগে চার্চটিতে প্রথম এই রাতে ঘুমানোর পরিষেবা শুরু করেন। ৭৯ বছর বয়সি মোসার বলেন, তিনি নিজে খুবই সামান্য অর্থে জীবন কাটিয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই তিনি অন্যদের সহায়তার জন্য এত আকুতি অনুভব করেছেন।
জার্মান অ্যাসোসিয়েশন ফর হোমলেস অ্যাসিসট্যান্স (বিএজি ডাব্লিউ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভেরেনা রোজেনকে ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘গৃহহীনতা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা।'' সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের চরম ঘাটতিকেই গৃহহীনতার প্রধান কারণ হিসাবে মনে করেন তিনি।
গৃহহীনতা প্রতিরোধের চাবিকাঠি
জার্মানিতে জরুরি আবাসন সহায়তা পরিষেবা এবং সুবিধাগুলোর জন্য জাতীয় সংস্থা হচ্ছে বিএজি ডাব্লিউ৷ সংস্থাটির সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে জার্মানিতে ছয় লাখ সাত হাজার মানুষ গৃহহীন ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই রাস্তায় থাকতেন।
ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিস শুধু সেবাকেন্দ্রগুলোতে নিবন্ধিত গৃহহীন ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী জার্মানিতে এমন তিন লাখ ৭২ হাজার ৬০০ মানুষ রয়েছেন।
কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই দুই পরিসংখ্যানে বড় পার্থক্য দেখা দেয়। বিএজি ডাব্লিউ নির্দিষ্ট দিনের পরিবর্তে পুরো বছরই তথ্য সংগ্রহ করে। তথাকথিত গোপন গৃহহীনতার তথ্যও তারা অন্তর্ভুক্ত করে, অর্থাৎ তাদের এই পরিসংখ্যানে যেসব গৃহহীন মানুষ বাড়ি হারানোর পর বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে থাকেন এই সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রোজেনকে বলেন, "(গৃহহীনতা) প্রতিরোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।" তার মতে, ‘‘আমাদের শুরুতে মানুষের বাড়িঘর হারানো রোধ করতে হবে। অনেকে এমনকি জানেনও না যে তারা আবাসন সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারেন বা কীভাবে নাগরিক ভাতার জন্য আবেদন করতে পারেন।'' হোটেল বা অন্যান্য বাসস্থানে প্রায়শই রাত্রিযাপনের জন্য অর্থায়নের পরিবর্তে ভাড়া ঋণ গ্রহণ করলে সেটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জন্যও সাশ্রয়ী হবে।
গৃহহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বেশ কয়েকটি অপেক্ষাকৃত সস্তা পদক্ষেপও বাতলে দিয়েছেন রোজেনকে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাইভেট বাড়ির মালিক এবং আবাসন শিল্পের কাছ থেকে হাউজিং স্টক কেনার সুবিধা। অথবা জরুরি বাসস্থানের সংস্কার এবং তাদের সামাজিক আবাসনে রূপান্তর।
জার্মানির জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বছরে চার লাখ নতুন বাড়ি নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এর মধ্যে এক লাখ ছিল কল্যাণ বা সামাজিক আবাসনের জন্য। যেসব মানুষের সামাজিক আবাসন সার্টিফিকেট রয়েছে, তাদেরকে বাজারের চেয়ে কম এবং নির্দিষ্ট মূল্যে বাসা ভাড়া দিলে সেই বাড়ির মালিক রাজ্য থেকে ভর্তুকি পান। একেই বলা হয় সামাজিক আবাসন ব্যবস্থা।
কিন্তু সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ থেকে অনেক দূরে রয়েছে। ভেরেনা রোজেনকে অবশ্য মনে করেন, "ফেডারেল সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি বছর এক লাখ সামাজিক আবাসন ইউনিট তৈরি করলেও তা সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের অভাব মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট হবে না।"
সামাজিক আবাসনে গৃহহীন লোকদের জন্য নির্দিষ্ট কোটার দাবিও জানান রোজেনকে। গৃহহীনদের প্রায়শই নানা সংস্কারের কারণে সম্ভাব্য ভাড়াটে হিসেবেও বিবেচনা করা হয় না।
২০২৪ সালের শুরু দিকে মন্ত্রিসভায় একটি কর্ম পরিকল্পনা গৃহীত হতে পারে। এর সাহায্যে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে গৃহহীনতার অবসান ঘটানোর অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে জার্মান ফেডারেল সরকার। তবে ১৬টি জার্মান রাজ্য, শহর এবং পৌরসভায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে৷
বেটিনা শ্টেক্যাম্পার/এডিকে