বিদেশে সমাদর আর দেশে অনাদরের ‘আম কাঁঠালের ছুটি'
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩হলমালিক আগেই সরিয়ে নিয়েছেন তার ছবি, দেখতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন অনেক দর্শক!
একটা জাদুকরী জগৎ। সেই জগতে পাকুর গাছের ডালে মাচা বেঁধে ঘুমায় মনোয়ার। তার দস্যিপনায় মৌমাছিরও নিস্তার নেই । আভাস পেলেই তাড়া করে সেই মৌমাছি নামে 'বল্লা'। মনোয়ারের সেই জগতেই মিশে যায় শহুরে শুভ, যাকে ভয় দেখায় তাল গাছের ওপর বসবাস করা অশরীরি কেউ। তাদের সাথে মনোয়ারের ছোট ভাই আনোয়ার আর মিতু, রীতু। সবাই মিলে যে জগতের সন্ধান মিলে না শহরে কিংবা আজকের গ্রামেও, সেই জগতেরই সন্ধান দিলেন সিনেমা নির্মাতা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান তার প্রথম ছবি 'আম কাঁঠালের ছুটি'তে।ঢাকার হলগুলোতে চলেছে শৈশবকে হাতছানি দেয়া সিনেমাটি। যারা দেখেছেন, তারা বলছেন, শিশুতোষ চলচ্চিত্রের আকালে 'আম কাঁঠালের ছুটি' এক মুঠো স্নিগ্ধ বাতাস।
দীর্ঘ আট বছর আগে সিনেমাটির নির্মাণ শুরু করেন নুরুজ্জামান। পেশায় স্থপতি, নেশায় নির্মাতা তার এই ছবিটি নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। পেয়েছেন পুরস্কারও। তবে দেশে তার অভিজ্ঞতা মন খারাপের। মাত্র চারটি সিনেপ্লেক্সে সিনেমাটি চলেছে এক সপ্তাহ। এর মাঝে একটি সিনেপ্লেক্সে প্রতিদিন শো চালায়ওনি। শিশুদের জন্য এমনিতেই সিনেমা খুব একটা তৈরি হয় না। যা তৈরি হয়, তা-ও দর্শকের কাছে পৌঁছায় না।
'ডুমুরের ফুল' থেকে 'আম কাঁঠালের ছুটি'
স্বাধীনতার আগে ১৯৬৬ সালে ফজলুল হক পরিচালিত 'সান অব পাকিস্তান' একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের গল্প নিয়ে নির্মিত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীভিত্তিক সেই ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন ফরিদুর রেজা সাগর। সিনেমাটি তেমন সফল না হলেও বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭৮ সালে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর স্কুলপাঠ্য গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি'কে 'ডুমুরের ফুল' নামে চলচ্চিত্রায়ন করেন খ্যাতিমান পরিচালক সুভাষ দত্ত। তবে ছোটদের জন্যে এটি নির্মিত হয়নি। কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক কিশোরের জীবনকাহিনি বর্ণিত হওয়ায় এটি শিশুকিশোরদের বিশেষ আকর্ষণ করেছে।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিশুতোষ চলচ্চিত্র ধরা হয়১৯৮০ সালে নির্মিত বাদল রহমানের 'এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী' কে। ১৯১৯ সালে জার্মান লেখক এরিখ কাস্টনার রচিত এমিলের গোয়েন্দা দল নামক কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাসের আলোকে এটি নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন বাদল রহমান। এটি ছিল সরকারী অনুদান প্রাপ্ত প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র। শিশুতোষ গোয়েন্দাভিত্তিক এই ছবিটি জনপ্রিয়তা পাবার পাশাপাশি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ৫টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
একই বছর মুক্তি পায় আজিজুর রহমানের কালজয়ী ছবি 'ছুটির ঘন্টা '।শিশুতোষ এই ছবিটি এখনো সমান দর্শকপ্রিয়।মূলত এই ছবির পরই বাংলা চলচ্চিত্রে শিশুরা বিশেষ স্থান করে নেয়। এই ১৯৮০ সালে শিশুতোষ ছবি আরেকটি মুক্তি পায়। খান আতাউর রহমান পরিচালিত ছবিটির নাম 'ডানপিটে ছেলে'। ছবিটি তখন আলোচিত হবার পাশাপাশি একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কারও লাভ করে। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় সি বি জামানের জনপ্রিয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র 'পুরস্কার'। সেটি ছিল কিশোর অপরাধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ছবি। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ৫টি পুরস্কার লাভ করে।
আশির দশকে শিশুদের অন্যতম প্রধান চরিত্র করে বেশ কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়,এর মধ্যে মাসুম,এতিম,রামের সুমতি,ক্ষতিপূরণ,রাঙা ভাবী অন্যতম।
আশির দশকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে শিশুদের বিশেষ স্থান দেয়া হয়েছিল, তা নব্বই দশকে এসে ক্রমশ কমতে থাকে। এর মাঝেও ১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'দীপু নাম্বার টু' বেশ আলোচিত হয়। ড.মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে ছবিটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। প্রথম ছবি নির্মাণের ২০ বছর পর বাদল রহমান ১৯৯৯ সালে নির্মাণ করেন শিশুতোষ চলচ্চিত্র 'ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ'।
২০০০ পরবর্তী সময়ে আবার বাংলা চলচ্চিত্রে শিশুদের নিয়ে ভাবা শুরু হয়।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না'। সত্তরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিটি জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে পুরস্কার লাভ করে।বাংলাদেশের অস্কারযাত্রা এই ছবির মাধ্যমে।২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা গল্প নিয়ে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন 'দূরত্ব'। একে একে নির্মিত হয় লিলিপুটরা বড় হবে,কাবুলিওয়ালা,দূরবীনসহ বেশ কিছু শিশুতোষ চলচ্চিত্র।বাণিজ্যিক ধারায় ও শিশু চরিত্রের প্রভাব পড়তে থাকে, এর মধ্যে চাচ্চু,অবুঝ শিশু উল্লেখযোগ্য।
২০১০ সালের পর শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ তুলনামূলক বেড়ে যায়, তবে বেশিরভাগ ছবিই অজ্ঞাত থেকে যায়। এই সময়ে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে আলোচিত 'আমার বন্ধু রাশেদ'। ড.জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। ২০১৫ সালে নির্মিত আশরাফ শিশিরের 'গাড়িওয়ালা' ছবিটি বেশ আলোচিত হয়। এছাড়া জালালের গল্প, বৈষম্য, শোভনের স্বাধীনতা, মুক্তি,আকাশ কত দূরে,শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য। আছে 'আঁখি ও তার বন্ধুরা', 'এডভেঞ্চার অব সুন্দরবন'সহ আরো কিছু শিশুতোষ চলচ্চিত্র।
বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় শিশুশিল্পীর নাম নিলে প্রথমেই নাম আসে মাস্টার শাকিল, মাস্টার সুমন ও দীঘি। শাকিল ও দীঘি জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তিনবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। সুমন জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন একবার। দীপু খ্যাত অরুণ সাহা একটি ছবিতে অভিনয় করলেও রয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা, জাতীয় পুরস্কার ও অর্জন করে দীপু। এছাড়া জয়া,প্রিয়াঙ্কাও বেশ আলোচিত হয়।
দীর্ঘদিন পর আবার শিশুদের জন্য ছবি
‘মজার স্কুল'-এর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখানো হয়েছে 'আম কাঁঠালের ছুটি' ছবিটি৷ বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ৯৭ মিনিটের সাদাকালো ছবিটি দেখে আনন্দ পেয়েছে বলে জানায় তারা। কখনো মনোয়ারের কাণ্ড-কীর্তি দেখে নিজেদেরই ওরা 'মনোয়ার' ভেবেছে, কখনো ভেবেছে শহুরে শুভ, কখনোবা মনোয়ারের ছোট ভাই আনোয়ারের পক্ষ নিয়েছে। ছবি দেখে তাদের একজন বললো, ‘‘আমরা তো এখন মোবাইলেই সারাক্ষণ থাকি। নারকেল পাতায় চশমা বানাবো কখন? কখনই বা লাটিম খেলবো?''
ছোটরা ছবিটি দেখে প্রায় সারাক্ষণই হেসেছে। তবে বড়রা করেছে হাহাকার। সে হাহাকার নিজেদের শিশুদের এমন শৈশব দিতে না পারার। এমনই একজন শিল্পী, সংগঠক অমল আকাশ। ছবি দেখে অনুভূতি ভাগ করেছেন ফেসবুকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘এ সিনেমাটি বড়দেরই দেখা উচিত। পাড়ায় পাড়ায় এখনো যেসব খেলার মাঠ দখল হয়ে যায় নাই, আমরা যেন সেগুলো আমাদের শিশুদের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারি। পরিচালক তার প্রথম সিনেমায় খুব সাদামাটাভাবে আমাদের শৈশবের কিছু দুরন্তপনার ডকুফিকশন নির্মাণ করতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি সফল বলে মনে করি।''
ফেসবুকে আহমেদ বাবলু নামে একজন লিখেছেন , ‘‘আমি হলভর্তি দর্শকের মাঝে অপার্থিব আলো লক্ষ্য করেছি। শৈশবের দিন দূরে ছেড়ে আসা যে কোনো মানুষ যখন ছবিটা দেখবেন, মনে হবে চোখের সামনে দুরন্ত শৈশব কোনো এক জাদুমন্ত্রে হঠাৎ হাজির হয়ে গেছে।''
রম্যলেখক, সাংবাদিক আহসান কবির একটি অনলাইন পত্রিকায় লিখেছেন, ‘‘এমনিতেই মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা কালচার ছিল স্কুলের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া। অনেক কবি সাহিত্যিকের লেখায় এমন ‘অ্যাডভেঞ্চার' আছে, হোক সেটা সত্যজিতের ‘ফেলুদা' কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু'। ছবিতে আবার তেমন নির্দিষ্ট কোনও গল্প হয়তো নেই, আছে গ্রামে দুরন্তপনার কিছু পরিস্থিতির চিত্রায়ন, যেটা শৈশবকে গেঁথে রাখে! জীবনের সবচেয়ে রঙিন এই সময়টাকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে সাদা কালো প্যালেটে, কোনও গান বা প্রায় আবহ সংগীত ছাড়া। পরিস্থিতি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বাস্তব শব্দই ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ছবির শুটিং হয়েছে গাজীপুরের হারবাইদ গ্রামে। এই ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে কিছু প্রচলিত ছড়াও। যেমন-
ওয়ান টু থ্রি/ সাবে খায় বিড়ি/ বিড়িতে নাই আগুন/ পাইলাম একটা বাগুন/ বাগুনে নাই বিচি/ পাইলাম একটা কেচি/ কেচিতে নাই ধার/ পাইলাম একটা হার/ হারে নাই লকেট/ পাইলাম একটা পকেট/ পকেটে নাই টাকা/ কেমনে যামু ঢাকা?/ ঢাকায় নাই গাড়ি/ ফিরে আইলাম বাড়ি/ বাড়িতে নাই কাম/ গাছে পাকে আম/ আম কাঁঠালের গন্ধ/ হাই স্কুল বন্ধ৷ ''
পরিচালকের আক্ষেপ
আম-কাঁঠালের ছুটি ছবির পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এত সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করা ছবিটি বেশিদিন হলে দেখানোর সুযোগ না পাওয়ায় হতাশ৷ বলছিলেন, ‘‘একটা ছবির হল জার্নি ছোট হলে একটু মন খারাপ তো হয়ই। তবে বেশ ভালো অভিজ্ঞতাও হয়েছে। অনেকেই দেখেছেন. যাদের আমি দর্শক মনে করি না। তারা ভালোবেসেই দেখেছেন। খুব কম লোক দেখেছেন অবশ্য। কোনোসময়ই হাউসফুল হয়নি। যারা দেখেছেন, তারা পছন্দ করেছেন।
আমি চেয়েছি, দর্শক ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখুক। সেই কারণে আমি সাদাকালোটা ব্যবহার করেছি। কারণ, রঙ যখন থাকে, তখন অনেক কিছুই আপনি ইমাজিন করেন না। বড়রা যখন দেখেছেন, তখন তারা রঙটা 'রিকল' করেছে। আর ছোটরা এটি যখন রিয়েল লাইফে দেখবে, তখন মনে করবে, এটার রঙ আমি দেখিনি। এখন দেখছি, এটা এরকম।
যমুন ব্লকবাষ্টার আমার ছবিটা পুরো সপ্তাহের জন্য নিয়েছে, কিন্তু প্রদর্শন করেনি। অনেক দর্শকই গিয়ে ফিরে এসেছে। কেন, আমি জানি না।
এর আগেও অনেক ছবি'র বেলায় এমন হয়েছে। 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' থেকে শুরু করে এমন অনেক ছবি, যেগুলো হল পায়নি। আমি মনে করি, এমন একশ'টা ছবি শহীদ হতে হবে, তখন লোকে বুঝতে পারবে, এই ছবিগুলোর প্রয়োজন। আমি শহীদের কাতারে পড়ে গেলাম, আর কি!
দেশের বাইরে পুরস্কৃত
ছবির গল্প লিখেছেন শরীফ উদ্দিন সবুজ। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, চিত্রনাট্য তৈরি, পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। ছবিটি রাশিয়ার ১৬তম চেবকসারি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের স্পেশাল জুরি আ্যাওয়ার্ড এবং রাশিয়ার উল্লিয়ানাভাস্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফারের অ্যাওয়ার্ড জেতে।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে শুটিংয়ের সময়কার শিশুরা এখন হয়তো কৈশোরে পা দিয়েছেন। একজন ছাড়া ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আগে কখনো অভিনয় করেননি। দুরন্ত মুইন্যার (মনোয়ার) ভূমিকায় অভিনয় করেছেন লিয়ন এবং শুভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জুবায়ের। আনোয়ার বা আনাইর চরিত্রে আরিফ, মিতা চরিত্রে তানজীল, রিতা চরিত্রে হালিমা এবং মুইন্যার মা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফাতেমা।