1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্র সংসদ না থাকায় জাতীয় রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত

সমীর কুমার দে ঢাকা
৮ অক্টোবর ২০১৮

ছাত্র সংসদ নেই বলে ক্যাম্পাস প্রায় সংঘর্ষহীন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নেই– এমন পর্যবেক্ষণ কতটা ঠিক? এসব বিষয়ে ছাত্র সংসদের সাবেক নেতারা কী বলেন?

https://p.dw.com/p/365tQ
ছবি: bdnews24.com

ছাত্র সংসদের সাবেক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মনে করেন, ছাত্র সংসদ থাকলে এখনকার ছাত্র নেতারাই অনেক বেশি যোগ্য হয়ে বের হতেন৷ যোগ্য ছাত্র নেতৃত্বের অভাবে জাতীয় রাজনীতিতে একটা কৃত্রিমতা তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে সেই সুযোগটা নিয়ে ব্যবসায়ী-আমলারা রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন বলেও মনে করেন তাঁরা৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মো. আখতারুজ্জামান৷ তিনি ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে পরপর দুই বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ এবং পরের বছর তিনি ভিপি নির্বাচিত হন৷ আর কোনো নেতা কখনোই দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনবার নির্বাচিত হতে পারেননি

বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. আখতারুজ্জামান সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার ছাত্র সংসদ নির্বাচনহীন অবস্থার পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যখন ছাত্র সংসদ ছিল, আর এখন যে ছাত্র সংসদ নেই এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটা বিরাট পার্থক্য৷ আমি যখন ডাকসু পরিচালনা করেছি, তখন অভিষেক অনুষ্ঠান হতো৷ সবগুলো ছাত্র সংগঠন যে যার মতো নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করত৷ মেনিফেস্টো দিত, লিফলেট দিত৷ এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একটা ভাব এগিয়ে যেত৷ তখন নতুন যারা ক্যাম্পাসে আসত, তারা অনেক কিছু জানতে পারত৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বা সামনের দিনে কী করতে হবে৷

মো. আখতারুজ্জামান

তিনি বলেন, ‘‘তখন আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনের পাশাপাশি সাহিত্য সপ্তাহ করতাম, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ করতাম, নাট্য সপ্তাহ করতাম, ক্রীড়া সপ্তাহ করতাম৷ তখন সবকিছু একটা জাতীয় প্রতিযোগিতার মতো হতো৷ তখন আমরা বিভিন্ন গুণীজনকে এনে এসবের বিচারক করতাম৷ সবকিছু মিলিয়ে এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টিভিটিজ হলেও একটা জাতীয় প্রতিযোগিতায় রূপ নিতো৷ তখন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হতো৷ তখন অ্যাকাডেমিক শিক্ষার বাইরে এক্সট্রা একটা গুণাবলী তৈরি হতো৷ ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে তাঁরা গড়ে উঠত৷ ছাত্র সংসদ না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা এই বিশাল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷''

কিন্তু বাস্তবতা হলো যখন ছাত্র সংসদ ছিল, তখন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী খুনের ঘটনা, হানাহানির ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটত৷সেই তুলনায় এখন ছাত্র সংসদ না থাকলেও সেই ধরনের হানাহানির ঘটনাও কিন্তু নেই৷ সমালোচকদের এমন একটি যুক্তি তুলে ধরলে তার জবাবে জনাব আখতারুজ্জামান বলেন, ‘‘একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে তখন হয়ত কিছু হানাহানি হয়েছে, কিন্তু একটা ঘটনা দিয়ে তো ডাকসুর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ঢাকা যাবে না৷ আরেকটা কথা হলো, ডাকসু থাকলে হানাহানি হয়, না থাকলে হানাহানি হয় না– এই কথাটাও কিন্তু যৌক্তিক নয়৷ এটাকে কোনোভাবেই আমি সমর্থন করতে পারি না৷'' ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে ছাত্র নেতৃত্বে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখন যে ছাত্র নেতৃত্ব বের হচ্ছে, ডাকসু থাকলে এই ছাত্র নেতৃত্বই অনেক বেশি উন্নতমানের যোগ্যতা অর্জন করত৷''

ম হামিদ

নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম হামিদ ১৯৭২ সালে ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সময় ছাত্রনেতৃত্ব গড়ে উঠত ডাকসুকে কেন্দ্র করে৷ শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব না, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব, সাংবাদিক বা সাহিত্যিক বা অনেক শিল্পী সামনে আসতে পেরেছেন৷ এটা কিন্তু শুধু রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়৷ শিক্ষার বাইরে অন্যান্য যে গুণাবলী তাঁদের আছে, সেই জিনিসটা বের হয়ে আসত৷ এটা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বহুকাল বঞ্চিত হয়ে আসছে৷ আমি মনে করি, এটা সব সময় থাকা উচিত এবং নিয়মিতভাবে এর নির্বাচন হওয়া উচিত৷ এতে ছাত্রদের সাংগঠনিক নেতৃত্বের যোগ্যতা তৈরি হতো৷''

ছাত্র নেতৃত্ব আগে কেমন ছিল, আর এখন কেমন? এর মধ্যে গুনগত কোন পার্থক্য আছে? ম হামিদ বললেন, ‘‘অনেক পার্থক্য৷ তখন যাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে বেড়িয়ে এসেছেন, তাঁরা দেখেন সবাই জাতীয় রাজনীতিতে সামনের সারিতে আছে৷ আর এখন দেখুন, যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে একটা কৃত্রিমতা তৈরি হয়েছে৷ এখন ব্যবসায়ীরা, যাঁরা সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছেন সেই আমলারা অবসরে গিয়ে রাজনীতিতে যাচ্ছেন৷ এর ফলে তাঁদের চাকরি জীবনেও একটা প্রভাব পড়ছে৷ কোন দলে তারা যোগ দেবেন, সেই দলের প্রতি চাকরির সময়েই বিশেষ আনুগত্য তৈরি হচ্ছে৷ আগে এই প্রবণতা ছিল না৷ আগে ছাত্র সংসদের নির্বাচন যাঁরা করত, তাঁরা একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগুতো৷ এটা সকল দিকেই৷ রাজনীতি বলেন, আর প্রশাসন বলেন, তাঁরা আসলে কোন দিকে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা ছাত্র জীবনেই নিয়ে আসত৷ আর এখন ছাত্র জীবন শেষ করে অনেকে সিদ্ধান্ত নেন এখন তিনি কী করবেন৷ এর ফলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় এবং অনেক মেধার অপচয় হয়৷''

ফজলে হোসেন বাদশা

১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ রাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে একটি আদর্শ ছাত্র সমাজ গড়ে ওঠে৷ ছাত্র সংসদের কারণে গণতান্ত্রিক একটা চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে৷ প্রতি বছর এই নির্বাচন হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে ছাত্র সমাজের সামনে তাঁদের ভাবমূর্তি রক্ষায় কাজ করতে হয়৷ এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বিচ্ছৃঙ্খলা, অপরাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা অনেকাংশেই কমে যায়৷ এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা, তার মূল কারণ হলো ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত না হওয়া৷ আমাদের সময় আমরা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি৷ কিন্তু তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই ধরনের সহিংসতা বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করিনি৷ এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল৷''

ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ হতো বলে সেই সময়কে, এবং সেই সঙ্গে প্রকারান্তরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গুরুত্বকে ছোট করে দেখার তিনি ঘোর বিরোধী৷ এ প্রসঙ্গে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘‘ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করতে আদর্শভিত্তিক ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে হয়৷ কিন্তু এখন যেটা হয়েছে বাহুবল বা ভয় দেখিয়ে ছাত্র সমাজকে দমিত করে বাধ্য করা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে যেতে৷ ফলে দুটো কিন্তু আলাদাধারা৷ একটা হলো গণতান্ত্রিক আর আরেকটা হলো সন্ত্রাসভিত্তিক৷ সবশেষে আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দরকার৷ এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছাত্ররা উদ্ভুদ্ধ হবে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখবে৷''

রুহুল কবির রিজভী আহমেদ

১৯৮৯ সালে রাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বলব, যখন ছাত্র সংসদ ছিল, তখন সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল না তা নয়, তবে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল৷ তখন সবগুলো ছাত্র সংগঠনের একটা সহাবস্থান ছিল৷ এখন ছাত্র সংসদ নেই, কোনো সহাবস্থানও নেই৷ একদলীয় অবস্থান হচ্ছে ক্যাম্পাসগুলোতে৷ ফলে অরাজকতার মাত্রা বেড়েছে, সিট বাণিজ্য বেড়েছে, হল দখল বেড়েছে৷ এতে করে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ যখন সহাবস্থান ছিল, তখন এই অনাচারগুলো হওয়ার সুযোগ ছিল না৷ তখন কোনো ছাত্র সংগঠন কোনো অনাচার করলে অন্য ছাত্র সংগঠন থেকে সেটার প্রতিবাদ করা হতো৷ আমরা দেখেছি, তখন নির্বাচনের সময় সবচেয়ে ভালো ছাত্র,ছাত্রী বা মেধাবীদের সবাই ভোট দিতো৷ যারা সন্ত্রাসী, দুষ্ট প্রকৃতির, তাদের কেউ ভোট দিত না৷ ছাত্র সংসদ না থাকায় ক্যাম্পাসগুলো দুর্বৃত্তদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে৷''

ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমি সন্দিহান৷ কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহাবস্থান নেই৷ যে ছেলেটি ছাত্রদল বা বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে সমর্থন করে, সে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারে না৷ এমনকি তার প্রধান যে কাজ, যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সেই ক্লাস-পরীক্ষাও সে দিতে পারছে না৷ সে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, হতাশ জীবন যাপন করছে৷ ফলে এই পরিস্থিতিতে আমি আশার কিছু দেখছি না৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান