সমস্যা সংস্কৃতির, ছাত্রদের নয়
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস সুবিদিত৷ প্রশংসিত৷ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছাত্ররা কী না করেছে৷ কত শত অর্জন৷ সুগৌরবে মাথা উঁচু করে বলে বেড়ানোর মতো ব্যাপার সব৷
পরে কী যেন হয়ে গেল৷ আস্তে আস্তে সফেদ চুনকাম করা ভবনটির পলেস্তারাগুলো খসে খসে পড়তে শুরু করল৷ এখন ছাত্র রাজনীতির উপর বিরক্ত, বিরূপ লোকসমাজ৷ চায়ের কাপে সুনামি ওঠা বিতর্ক হলো, ছাত্র রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা৷ সে বিতর্কে দু-একটি কথা পরে বলি৷ তার আগে একটা কথা বলে নিই৷ তা হলো, গণতান্ত্রিক ধারায় শোষিত সমাজের রাজনীতি, আর স্বশাসিত সমাজের রাজনীতি কখনো এক হয় না৷
ব্যতিক্রম হয় কেবল একনায়কতন্ত্রের পাটার তলে পড়ে চ্যাপ্টা হলে৷ '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান তার প্রমাণ৷ '৪৭-এর পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বের গোটা মানচিত্রটাকে শোষণ করতে করতে একেবারে জরাজীর্ণ করে ফেলেছিল, সে কথা সবাই জানেন৷ তাই সে সময় এক দেশ হলেও পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ ছিল শোষিত সমাজ৷
ব্যাপারটা এমন যে, শোষিত সমাজের একটা ‘সাধারণ শত্রু' থাকে৷ তা হলো শোষক গোষ্ঠী৷ সেই শত্রুর বিরুদ্ধে কিছু সুবিধাবাদী আগাছা বাদ দিলে শোষিত সবাই এককাট্টা৷ তাই সে সময় আন্দোলন সংগ্রামে যাঁরা ভুমিকা রাখেন, তাঁরা নায়ক হন৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে-সংগ্রামে ছাত্ররা অগ্রগামী ভূমিকা রাখায় অতীতের ছাত্র রাজনীতি সবসময়ই নায়কের আসনে৷
স্বশাসিত সমাজে ধীরে ধীরে পালটাতে থাকে রাজনীতির হুলিয়া৷ গণতন্ত্রের পুনর্বাসনের পর অবস্থা আরো পাল্টায়৷ সাধারণ শত্রু পরিণত হয় ‘ক্ষমতা'-র প্রতিদ্বন্দ্বীতে৷ চিন্তা চেতনায় ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত না হতে পারা সমাজে সরকার গঠনের ধারণাটিই যখন ‘ক্ষমতায় যাওয়া', তখন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে মাঠে ময়দানে পেশিশক্তির দাপট দেখানোই রাজনীতি হয়ে ওঠে৷ আর নায়কদেরও চরিত্র বদলে যায় তাই৷ ছাত্র রাজনীতিতেও ক্ষমতার লড়াইটিই মুখ্য হয়ে ওঠে৷ কিছু ব্যতিক্রম বাদে আন্দোলনে-সংগ্রামে ‘অরাজনৈতিক ছাত্ররাই' কেবল ধরে রাখে অতীতের স্বর্ণযুগের চেতনা৷
কাড়াকাড়ির রাজনীতির চৌকাঠ মাড়িয়ে যখন ছাত্রের হাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, তখন কিছু সময়ের ব্যবধানে পত্রিকার সম্পাদককে একবার লিখতে হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগ সামলান!' আবার লিখতে হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদল সামলান!'
মনে পড়ে, হলে সিট পাবার জন্য যখন হলের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্টের কড়া নাড়লাম, তখন তিনি পাঠালেন আরেক নেতার কাছে৷ সেই নেতা কয়েকদিন ধরে খালি ঘুরাতেই থাকেন৷ অনেক ঘুরিয়ে পরে, একই দলের একাধিক গ্রুপের টানা হ্যাঁচড়ার পর যে রুমে ওঠা গেল, সেখানে কখনো আলো জ্বলে না৷
অন্ধকার ঘরে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে চার বেডের এক রুমে দু'জন থাকতে শুরু করি৷ রুমেরও যে রাজনৈতিক তকমা হয়, সেটি সেখানেই টের পেলাম৷ সেইসঙ্গে আমি ‘সৌভাগ্যবান', কারণ, যেখানে অন্যদের ১০-১২ জন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০-২৫ জনও এক রুমে থাকতে হয়, সেখানে আমি যে ‘সম্মান' পাই, তা বিরল৷
অবশ্য এতটা আদরে রাখার ফলাফল খুব মধুর ছিল না৷ তাই বেশিদিন সেখানে টিকতে পারিনি৷ কিন্তু আমি বেঁচে যাই, ঢাকা শহরে আমার অন্য ঠাঁই ছিল বলে৷ মফস্বল থেকে আসা অনেক ছাত্রছাত্রীরই সেই সুযোগ নেই৷ তাই হল থেকে কোনো কারণে ‘বিতাড়িত' হলে যাওয়ার জায়গা থাকে না৷ কিন্তু প্রতিবাদ ক'জন করেন৷ সব হজম করে, মেনে নিয়ে কষ্ট হলেও থেকে যেতে হয়৷
সবাই বাক্স-প্যাটরা নিয়ে প্রতিবাদে বসেন না৷ সবাই আফসানা আহমেদ ইভা হন না৷
কিছুদিন আগে আমাদের ছাত্র রাজনীতির নামে শিশু রাজনীতিও দেখতে হয়েছে৷ ছাত্রলীগ সব স্কুলে কমিটি করা শুরু করে দিলো৷ স্কুলের ছাত্ররা দেখলো ও দেখালো রাজনীতির দাপট! ভাগ্য ভালো যে, তা বেশিদুর এগোয়নি৷
প্রশ্ন হলো, এই ছাত্র রাজনীতির বলে বলীয়ান শিক্ষার্থীদের এ সংস্কৃতির ধারা কবে বন্ধ হবে? যারা অতি উৎসাহী অথবা অতি বিক্ষুব্ধ, তাদের কাছে মাথা ব্যথায় মাথা কেটে দেয়াই সমাধান৷
কিন্তু কোনো কোনো ওয়ালিদই কেবল ছাত্রসংসদ নির্বাচনের জন্য উঠে পড়ে লাগেন৷ দশকের পর দশক ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধের প্রতিবাদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বড় কর্মসূচি হয় না৷ যাঁরা এক সময়ের ডাকসু-চাকসুর নামকরা নেতা-নেত্রী, তাঁরা গালভরা কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেন৷ অনশন তো তাঁদেরই করার কথা৷ ওয়ালিদের নয়৷
সে কি আর হবে?
তাদের অনেকেই বরং উপাচার্যকে ‘উদ্ধারকারী রুস্তম' হওয়া, রড-লাঠি হাতে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করা এই ‘কোমলমতি' ছাত্রদের পিঠ চাপড়ান৷
ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷ মূলধারার রাজনীতির ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি বন্ধ না হলে এমনটাই চলবে বলেই মনে হয়৷ হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷