ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিতৃষ্ণা?
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ডয়চে ভেলে: বর্তমান ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
গীতি আরা নাসরীন: বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য যেটা থাকার কথা বা যে গতিশীলতা থাকার কথা, সেটা দেখতে পাই না৷ এটা যে শান্তিকালীন স্থিতিশীল অবস্থা তাও নয়৷ আসলে এটা চলৎশক্তিহীন একটা অবস্থা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, তাহলে এখানে দুর্নীতি আছে, নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা আছে৷ শিক্ষার্থীদের কথা বলার জন্য যে প্ল্যাটফর্মগুলো থাকার কথা, ছাত্র সংসদ থাকার কথা, সেটা এখন নেই৷ এই পরিস্থিতিতে একটা সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি থাকার কথা, এখন আমরা সেটা দেখতে পাই না৷ বর্তমান ছাত্র রাজনীতির আমরা দু'টি ভাগ দেখতে পাই৷ একটি হলো – রাজনৈতিক দলগুলোর যে অঙ্গ সংগঠন আছে, তাদের একটা তৎপরতা দেখা যায়৷ কিন্তু ছাত্রদের বড় একটা অংশের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিতৃষ্ণা আছে৷ ছাত্র রাজনীতি তো আসলে এমন যে, তারা সমাজের অসংগতি দেখবে, এমনকি সারা দেশের এই ধরনের অসঙ্গতি নিয়ে ভাববে, কিন্তু এখন আর আমরা সেটা দেখতে পাই না৷
হঠাৎ করে ছাত্র রাজনীতি উত্তপ্ত কেন? আপনার কী মনে হয়?
বিষয়টা যদি আমরা এভাবে না বলি, তাহলে দেখা যাবে, এখন শিক্ষার্থীদের রাজনীতির চালিকা শক্তি হলো প্রলোভন৷ রাজনীতি জায়গাটা আসলে ব্যক্তিস্বার্থ এবং ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এটা ইহকাল হোক আর পরকালই হোক৷ অল্প কিছু বাদে আমরা দেখব ছাত্র রাজনীতি লুণ্ঠন ও গুটিকয়েকের স্বার্থের জন্য কাজ করছে৷ এই কারণে আমরা ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান দেখব না৷ শিক্ষার্থীদের রাজনীতির মূল কথা যদি কতৃত্ব আর দখলই হয়ে যায়, সুস্থ্ রাজনীতির জন্য পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং একটা গণতান্ত্রিক চর্চা, সেটা যদি হারিয়ে যায় এবং ক্ষমতাসীন যারা, তারা যদি যতটা সম্ভব পরিসর দখল রাখার চেষ্টা করে, তখন নানা ধরনের উত্তপ্ত অবস্থা তৈরি হতে পারে৷ এই উত্তাপে বেশিরভাগ সময় নিজেদের দলের মধ্যেই হানাহানি হয়৷ অনেক সময় দেখা যায়, যারা এ সব বৈষম্য নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছেন, তাদের কণ্ঠরোধ করতেও উত্তাপের সৃষ্টি হতে পারে৷ এখন প্রধানত সেই ধরনের উত্তাপ আমরা দেখছি৷
ছাত্র রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত?
ছাত্র রাজনীতি তো আসলে সবার কল্যাণের জন্য হওয়া উচিত৷ প্রথমত শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য এবং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে৷ তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য৷ ছাত্রদের কণ্ঠস্বর আমরা তাদের মাধ্যমে শুনতে পাবো, এটাই সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি৷ ছাত্র সংগঠনগুলো তো আর বাইরের কিছু নয়, তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের সমস্যা এবং দেশের নানা প্রশ্ন জড়িত সেই সমস্ত নিয়ে রাজনীতিই হলো ছাত্র রাজনীতি৷ আসলে ক্ষুদ্র স্বার্থে নয়, সবার স্বার্থে যে রাজনীতি কাজ করে, সেটা ছাত্র রাজনীতি৷
ছাত্র রাজনীতি কি ছাত্রদের মধ্যে আছে, নাকি অছাত্রদের হাতে চলে গেছে?
ছাত্র রাজনীতিতে আমরা যাদের দেখতে পাই, তারা যদি কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন, সেটাও বড় কথা নয়৷ আমার কাছে মনে হয়, এখানে সবার অংশগ্রহণ নেই৷ যাঁরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁদের যদি কোনো রেজিস্ট্রেশনও থাকে সেটাও বড় কথা নয়৷ বড় কথা হচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত প্রতিফলিত হচ্ছে বা তারা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে কিনা৷
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নেই কেন?
আগেই বলেছি, ছাত্র রাজনীতির মূল কথা যেখানে কতৃত্ব আর দখল করা৷ ক্ষমতাসীন যাঁরা, তাঁরা যতটা সম্ভব পরিসর দখল করার কাজে ব্যবহার করেন বা ক্ষমতাসীন দলগুলো বা বিশ্ববিদ্যালয়েরও যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা এই পেশিশক্তিকে ব্যবহার করেন৷ ব্যক্তিগত লাভের জন্যও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ব্যবহৃত হতে চান বা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চান৷ এই নিয়ন্ত্রণের বিষয় যেখানে আসে, সেখানে সহাবস্থান কঠিন হয়ে পড়ে৷ এখানে তো কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই৷ এ সব কারণে এখানে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান কঠিন হয়ে পড়ছে৷
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন সবসময় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের উপর নির্ভরশীল?
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ক্ষমতাসীন যে দল থাকে, তারাই নির্ধারণ করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে কারা থাকবেন৷ পুরো প্রক্রিয়াটাই এখন এমন হয়েছে যে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরা রাজনৈতিক শক্তি দিয়েই টিকে থাকতে চান৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যাঁরা থাকেন, তাঁরাই যদি ক্ষমতায় যাবার উৎস হতেন, তাহলে আমরা ক্ষমতাসীন যাঁরা, তাঁদের হাতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ হতে দেখতাম না৷
আপনার কি মনে হয় ডাকসু নির্বাচন হবে? আদালতের রায় বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক?
আমরা বিভিন্ন মহল থেকে শুনছি, ডাকসু নির্বাচনের জন্য তারা চেষ্টা করছেন৷ উপাচার্য বলেছেন, এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানও বলেছেন৷ আর উচ্চ আদালতের রায় তো রয়েছেই৷ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ সবার যদি আন্তরিকতা থাকে, তাহলে ডাকসু নির্বাচন হওয়া সম্ভব৷
নির্বাচন না হলেও অর্থ নেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে৷ এটা বন্ধে শিক্ষকরা কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন?
দীর্ঘদিন ধরেই তো এটা নেয়া হচ্ছে৷ সত্যিকার অর্থেই এটা নিয়ে তো আলোচনা হওয়ার কথা৷ শিক্ষকদের যে ফোরামগুলো রয়েছে, সেখানে আলোচনা হওয়া উচিত৷ আসলে আমরা শিক্ষকরাও এই বিষয় সম্পর্কে অনেক সময় উদাসীন থাকি৷ ডাকসু না থাকার ফলে, সিনেটে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি না থাকার ফলে, তাদের দাবিও ঠিকমতো উত্থাপিত হচ্ছে না৷ ফলে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠের পুরোটা সবসময় জানতে পারছেন না৷
আপনি বলছিলেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা সব সময় অর্থের পেছনে ছোটেন, অনেকেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে যান৷ এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ কী?
এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার যে পথ সেটা তো জানা আছে৷ চাঁদা তোলা বা টেন্ডার – এগুলো তো তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বা দখলে রাখার জন্য তাদের পাইয়ে দেয়া হয়৷ কারা পাইয়ে দিচ্ছেন, তা তো আমরা সবাই জানি৷ এখন যারা এগুলো পাইয়ে দিচ্ছেন, তারা যদি এগুলো বন্ধ করেন, তাহলে এই অবস্থা থেকে উত্তরিত হওয়া এমন কঠিন কিছু নয়৷
শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিতে অধিক মনোযোগী ছাত্র সংগঠনগুলো, পরিস্থিতি উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
আমি মনে করি, উপর থেকেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, আবার তারা নিজেরাও সুযোগ-সুবিধা পেতে নিয়ন্ত্রিত হতে চান৷ শিক্ষাঙ্গনে কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা যদি বন্ধ করা হয়, বা তারা যদি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুস্থ্ পরিবেশ বজায় রাখতে চায়, তাহলে তাদের এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে থাকতে চান৷
ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয় থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিপুল প্রাণ রয়েছে, ইদানীংও আমি বিষয়টা লক্ষ্য করছি, তাদের মধ্যে একটা অবরুদ্ধ প্রাণ আছে৷ তারা তাদের কথা বলতে চায়, সমস্যার সমাধান চায়৷ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাগুলোকে তারা সত্যিকারের শিক্ষাঙ্গন হিসেবেই দেখতে চায়, অপরাজনীতিমুক্ত দেখতে চায়৷ এই শিক্ষার্থীদের এক জায়গায় হতে হবে৷ এক জায়গায় তারা হচ্ছেও৷ আমরা দেখেছি, আন্দোলন হয়েছে৷ সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন বা অপরাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন দেখতে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক হতে হবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷