‘হেফাজতকে কঠোরভাবে শায়েস্তা করা হবে’
২৮ নভেম্বর ২০২০শুক্রবার চট্গ্রামে এক মাহফিলে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘‘যারা ভাস্কর্য তৈরি করবে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হবে৷ আমার বাবার নামেও যদি কেউ ভাস্কর্য তৈরি করে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেব৷ বর্তমানে পুরো বিশ্বে আস্তিক আর নাস্তিকের লড়াই চলছে৷ আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে কোনো লড়াই নেই, তাদের আত্মীয়তার বন্ধন হয়৷ কিন্তু আস্তিক আর নাস্তিক কখনো এক হতে পারে না৷’’
এমন বক্তব্যকে ‘জঙ্গিবাদের ভাষা’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল-আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইসলাম শান্তির ধর্ম৷ কিন্তু তারা (হেফাজত) যে ভাষায় কথা বলছে, এটা জঙ্গিবাদের ভাষা, সংঘাতপূর্ণ ভাষা৷ ইসলামের নামে এ ধরনের মৌলবাদী, উগ্রবাদী কথা বললে এটা বরদাশত করা হবে না৷ তারা যদি ধর্মের নামে ভাস্কর্য নির্মাণে এভাবে বাধা দিতে আসে তাহলে তাদেরকে কঠোরভাবে শায়েস্তা করা হবে৷’’
এদিকে ভাস্কর্য বিষয়ে হেফাজতের এমন বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করছে সরকার৷ আর এ ব্যপারে সরকারকে কঠোর হতে বলছেন বুদ্ধিজীবীরা৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, এ ভাস্কর্য পূজা করার জন্য নয় সে বিষয়টি তারা বুঝতে পারছে না৷ বিশ্বের অনেক মুসলিম প্রধান দেশেও ভাস্কর্য আছে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তাদের (হেফাজতের) বক্তব্য আমরা শুনেছি৷ সব কথায় তো আর সরকার রিঅ্যাক্ট করে না৷ দেখা যাক, কয়েকজন আলেম তো এগুলো নিয়ে কথা বলছেন৷ আমরা তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছি৷ এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি৷''
ঢাকার ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বসানোর সরকারের উদ্যোগের পর গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কট্টরপন্থি ইসলামিক দলগুলো৷ এ বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলেচনায় আসেন হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল৷ শুক্রবার চট্টগ্রামে আয়োজিত এক মাহফিলে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল মামুনুল হকের৷ আর চট্টগ্রামে মামুনুল হককে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে রাজপথে নামে জঙ্গিবাদ বিরোধী ছাত্র যুব ঐক্য পরিষদ৷ সেখানে ছাত্রলীগ ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন৷ মাহফিলে অংশগ্রহণ করেননি মামুনুল হক৷
চট্চগ্রামের এ মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বাবুনগরী বলেন, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন মদিনা সনদে দেশ চলবে৷ আমরাও চাই মদিনা সনদে দেশ চলুক৷ ভাস্কর্য- এটা শরিয়তসম্মত নয়৷ কোনো পার্টি বা নেতার নাম বলছি না, যার ভাস্কর্য হোক না কেন, আল্লাহর কসম, কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য বসায়, আমি সর্বপ্রথম সেই ভাস্কর্য টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেব৷ যেকোনো দল ভাস্কর্য বসাবে, আমার আব্বার ভাস্কর্যও যদি স্থাপন করা হয়, সেটা শরিয়ত সম্মত হবে না৷ টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেব৷’’
হাটহাজারির মাহফিলের দিনে শুক্রবার চট্টগ্রামে জঙ্গিবাদবিরোধী ছাত্র যুব ঐক্য পরিষদের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল৷ সমাবেশে দেওয়া বক্তব্য নওফেল বলেন, তার দল গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী বলে এ ধরনের বিষয়ে প্রতিবাদ করছে না৷ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ না করার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মত তার৷
‘‘আজ মৌলবাদী গোষ্ঠী সারাদেশে হুমকি-ধামকি দিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে৷ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করি, এরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে, আমরা জানি৷ কিন্ত আমরা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী বলে সেটা করছি না৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে আজ ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে কেউ কেউ রাজনৈতিক কথাবার্তা বলছে, নিজের রাজনৈতিক খায়েশ মেটানোর চেষ্টা করছে৷ এই ধরনের কাজ আমাদের দেশে হচ্ছে৷ কেন হচ্ছে? আমাদের নিজেদের মধ্যে দুর্বলতার কারণে৷’’
তবে হেফাজতের এমন হুমকির দেওয়ার বিষয় সরকারকে দায়ী করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম৷ প্রবীণ এ অধ্যাপক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের প্রশ্রয়ে তো তারা আজকে এসব কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে৷ আজ তো তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য টেনেহিঁচড়ে ফেলার কথা বলছে, দু'দিন পর তারা অন্য সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে বলবে৷’’
হেফাজতের এমন আচরণ ‘শঙ্কার' উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আরেকটা জিনিস হল দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম না থাকায় এই ক্ষোভ বিক্ষোভগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না৷ আমার শঙ্কা, এরা যদি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভকে পুঁজি করে ফেলে তাহলে কিন্তু এখান থেকে বের হওয়ার পথ থাকবে না৷ ফলে আমি বলব, এখনই এ ব্যাপারে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’
তবে হেফাজতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসলামী ঐক্যজোট৷ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান ভাস্কর্য ও মূর্তি শব্দের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে যারা অপরাজনীতির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘এ দেশের মানুষ আপনাদেরকে ৭১ সালেও চিনতে ভুল করেনি, এখনও করবে না৷ প্রাণীর ভাস্কর্য মানেই শিরক নয়৷ বিশ্বের অনেক ইসলামি দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে৷’’
হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলাম কেন ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে মাঠে নামল এমন প্রশ্নের জবাবে হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনা জন্য গঠিত শূরা কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন নানুপুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা বলেছি, আজ আপনারা ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন কাল কেউ এসে সেটা ভেঙে ফেলবে৷ সাদ্দাম, গাদ্দাফির ভাস্কর্য এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে৷ বরং আপনারা যদি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে চান তাহলে ভাস্কর্য নির্মাণ করে টাকার অপচয় না করে তার নামে হাসপাতাল করুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করুন বা এমন কিছু করুন যা মানুষ মনে রাখবে৷’’দেশে তো আরো ভাস্কর্য আছে তাহলে কেন শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রতিবাদ করছেন? জবাবে জনাব নানুপুরী বলেন, ‘‘শুধু এটা না, আমরা তো বলেছি, সবগুলো ভাস্কর্যই ভেঙে ফেলতে হবে৷ যদি বিখ্যাতদের স্মরণ করতে চান তাহলে তাদের নামে এমন কিছু করুন যা মানুষের উপকারে আসবে৷ ভাস্কর্যের নামে মানুষের টাকার অপচয় তৌহীদী জনতা মেনে নেব না৷’’