হাজিদের সেবা দিতে সরকারি খরচে হজ
৩ জুন ২০২২তালিকাভুক্ত যাদের সঙ্গে ডয়চে ভেলের কথা হয়েছে, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও ‘‘হাজি সাহেবদের সেবা’’ করতে যাচ্ছেন- এমন একটি সাধারণ উত্তর পাওয়া গেছে৷
এরই মধ্যে তাদের তালিকা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাব রক্ষণ ও অর্থ কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে৷ সেই তালিকা ডয়চে ভেলেও সংগ্রহ করেছে৷ ২৭৯ জনকে প্রধানত চারটি ক্যাটাগরিতে নির্বাচন করা হয়েছে৷ ক্যাটাগরিগুলো হলো: মেডিকেল টিম, প্রশাসনিক সহায়তাকারী দল, এবং কারিগরি সহায়তাকারী দল এক ও দুই৷
চিকিৎসক দলে আছেন ১৩৮ জন, প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে ৯৯ জন এবং দুইটি কারিগরি সহায়তাকারী দলে ৪২ জন৷ তাদের প্রত্যেকের জন্য গড়ে সাত লাখ টাকা করে খরচ হবে৷ তবে তাদের যাওয়ার আগে প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হবে৷ বাকি টাকা আগামী অর্থ বছরে চূড়ান্ত বিল জমা দেয়া সাপেক্ষে পরিশোধ করা হবে৷ মোট ২০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে সরকারের এই খাতে৷
যারা যাচ্ছেন
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক থেকে সর্বোচ্চ পদ মর্যাদার মোট কর্মকর্তা আছেন ১২০ জন৷ তাদের মধ্যে ৬১ জনই এবার হাজি সাহেবদের সেবা করার জন্য হজে যাচ্ছেন৷ এছাড়া আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংসদ সচিবালয়, সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পুলিশসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী৷ তালিকায় গাড়ি চালক আছেন ১৫ জন, অফিস সহায়ক ও মুদ্রাক্ষরিক আছেন ১৫ জন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আছেন ১৫ জন৷
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক গাড়ি চালক, অফিস সহায়ক জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ একটি মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি খরচে হজে যাচ্ছেন৷
গিয়ে যা করবেন
মনিরুল ইসলাম ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা৷ তার মোবাইল ফোনের লাইনটি ভালোই ছিল৷ বুধবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথাও শুরু করেন, কিন্তু যখন জানতে চাওয়া হয় তিনি কী কাজে হজে যাচ্ছেন তখন তিনি বলেন, ‘‘ভাই আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি না৷ পরে কথা বলবো৷’’ এরপর লাইন কেটে দেন৷ আর তাকে পাওয়া যায়নি৷ তার নাম রয়েছে প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে৷ প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মো. মামুনুল করিম যাচ্ছেন কারিগরি টিমের সদস্য হিসেবে৷ কেন যাচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যারা হজে যাবেন, তারা যদি কোনো সমস্যায় পড়েন, তাদের সহায়তার জন্য যাচ্ছি৷ তারা যে সমস্যায় পড়বে, সেই সমস্যারই সমাধানের চেষ্টা করবো৷’’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হায়দার আলিও আছেন কারিগরি টিমে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার কাজ কী হবে তা এখনো জানি না৷ গত পরশুদিন ব্রিফিং হয়েছে৷ অন্য একটি কাজ থাকায় আমি ব্রিফিংয়ে থাকতে পারিনি৷ পরে জেনে নেবো৷ তবে মূল কাজ হবে হাজি সাহেবদের সেবা করা৷ আর আগে আমি ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি৷ তবে হাজি সাহেবদের সেবায় এবারই প্রথম যাচ্ছি৷’’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন৷ তিনি যাচ্ছেন মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে৷ তার কথা, ‘‘হাজি সাহেবদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি হজ মিশন নিয়েছে৷ তারপরও আমরা যারা মেডিকেল টিমে আছি, তারা ওখানে গিয়ে হাজি সাহেবদের চিকিৎসায় সহায়তা করবো৷’’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নুরুল আমিনও হজে যাচ্ছেন কারিগরি টিমের সদস্য হিসেবে৷ তার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "হাজি সাহেবদের সকল সেবা বা যে-কোনো ধরনের সহযোগিতার জন্য আমরা যাচ্ছি৷ আমরা মোট দুইজন যাচ্ছি৷ তবে এর বাইরে গানম্যান ও কনেস্টবলরাও যাচ্ছেন ভিআইপিদের সেবা দেয়ার জন্য৷’’
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘‘মিনা, আরাফা ও মুজদালেফা মিলিয়ে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পাঁচ দিন৷ এই সময়ে পুরোটা সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে৷ তখন সৌদি কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কোনো পক্ষের সেখানে চিকিৎসাসহ কোনো ধরনের সেবা দেয়ার সুযোগ নেই৷’’
তবে এর আগে-পরে প্রাথমিক চিকিৎসাসহ অন্য সেবা দেয়ার সুযোগ আছে বলে তিনি জানান৷ বিশেষ করে বাংলাদেশ হজ মিশনের উদ্যোগে সেখানে যে ক্লিনিক তাতে বাংলাদেশি মেডিকেল টিমের দরকার আছে হজের সময়৷
সংখ্যা আরো বাড়বে
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ( হজ অনু বিভাগ) মো. মতিউল ইসলাম জানান, ‘‘২৭৯ জনকে হাজি সাহেবদের নানা ধরনের সেবা দেয়ার জন্য পাঠানো হচ্ছে৷ তাদেরকে স্পষ্ট করেই বলে দেয়া হয়েছে যে, তাতের মূল কাজ হাজিদের সেবা করা৷ মূল কাজ হজ করা নয়৷’’
এত লোক হাজিদের কী সেবা দেবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আগে আরো বেশি গিয়েছে৷ এবার হাজি কম বলে কম পাঠানো হচ্ছে৷ তাদের কার কী কাজ তা নির্দিষ্ট করা আছে৷ যাদের প্রয়োজন, তাদেরই পাঠানো হচ্ছে৷ কোনো অতিরিক্ত লোক পাঠানো হচ্ছে না৷’’ তার কথা, হজ ব্যবস্থাপনা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ৷ তাই এই মন্ত্রণালয় থেকে বেশি যাচ্ছে৷ আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘আমরা সব মন্ত্রণালয়কেই খুশি রাখার চেষ্টা করি৷’’
এ বিষয়ে কথা বলতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীকে বুধবার প্রথমে ফোনে পাওয়া গেলেও তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান৷ তবে পরে আর তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি৷
মতিউল ইসলাম জানান, সরকারি খরচে হজে যাওয়াদের সংখ্যা আরো বাড়বে৷ প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে ৬০ জনের একটি তালিকা পাঠিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের না৷ সরাদেশ থেকে যারা তার কাছে আবেদন করেছেন, সেখান থেকে তিনি বাছাই করে পাঠিয়েছেন৷ তারা অসচ্ছল৷ তারা প্রধানমনস্ত্রীর সৌজন্যে হজে যাবেন৷’’
ধর্মমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী মমিটির ১০ জন সদস্যের প্রত্যেকের সুপারিশে তিনজন করে আরো ৩০ জন সরকারি খরচে হজে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানান তিনি৷
এবার সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে মোট ৫৩ হজার ৫৮৫ জন হজে যাচ্ছেন৷ প্রথমে সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ-১-এ পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা এবং প্যাকেজ-২-এ চার লাখ ৬২ হাজার ১৫০ টাকা এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে চার লাখ ৫৬ হাজার ৬৩০ টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়৷ পরে আরো ৫৯ হাজার টাকা বাড়ানো হয়৷