রাষ্ট্রের টাকায় হজ পালন নিয়ে বিতর্ক
৩ জুন ২০২২তবে এ বছর সারা বিশ্ব থেকে মোট ১০ লাখ মুসলমান হজ করতে পারবেন৷ এজন্য ৬৫ বছরের কমবয়সি হতে হবে এবং থাকতে হবে পূর্ণডোজ টিকা গ্রহণ৷ এই ১০ লাখের মধ্যে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারছেন ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন৷ এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চার হাজার ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫৩ হাজার ৫৮৫ জন হজে যাচ্ছেন৷ ৫ জুন থেকে বাংলাদেশি হজযাত্রী নিয়ে বিমান যাত্রা শুরু হওয়ার কথা৷
এদিক এ বছর বাংলাদেশ থেকে সরকারি খরচে ২৭৯ জন হজে যাবেন বলে ঠিক হয়েছে৷ এদের মধ্যে ৯৯ জন হজ প্রশাসনিক সহায়তা দল, ৪২জন কারিগরি দল এবং ১৩৮ জন চিকিৎসক দলের সদস্য হিসেবে যাচ্ছেন৷ সব মিলে এই হজ সহায়তা দলের ২৭৯ জনের পেছনে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানা গেছে৷
এমন নয় যে সরকারি খরচে হজে ও মক্কায় বাংলাদেশি হাজীদের সহযোগিতার জন্য যাওয়ার বিষয়টি নতুন৷ গত দু'বছর বাদে আগের প্রতি বছরই এভাবে কিছু মানুষ হজে গিয়েছেন সরকারি খরচে৷ ঠিক কবে থেকে এই প্রথা চলে আসছে তা সঠিকভাবে জানা গেলেও এই চর্চাটা নতুন নয়৷ এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও হয় প্রতিবারই৷ এবারও বিষয়টি নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়েছে৷ বিশেষ করে সরকার যখন এবার বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমানোর অন্যতম কৌশল হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে কিছুটা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তখন সরকারি খরচে হজে যাওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকে৷ কেউ কেউ এভাবে হজ পালন ইসলামের বিধানসম্মত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন৷ আবার কারো কারো প্রশ্ন হলো, যাদের এই হজ সহায়তা দলে নেয়া হচ্ছে, তাদের সবাই এ কাজের যোগ্য কি না৷ তবে এসব প্রশ্ন ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে চটজলদি কোনো উপসংহারে উপনীত হওয়ার আগে কিছু বিষয় একটু পর্যালোচনা করা প্রয়োজন৷
হজ হলো ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি৷ শারীরিক-মানসিক-আর্থিকভাবে সক্ষমপ্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ বা বাধ্যতামূলক৷ প্রতি আরবী বা চন্দ্র বছরের জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ মক্কা শরিফ, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ও জামারায় নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে ইহরামের পোশাকে জড়ো হওয়া ও অবস্থান করাসহ ইবাদত-বন্দেগি ও নির্ধারিত বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হলো হজ৷
সরকারি খরচে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গাটি হজের অর্থায়ন নিয়ে৷ যেহেতু নিজে সামর্থবান হলেই নিজের বৈধপথে উপার্জিত টাকা দিয়ে হজ করার ওপর ইসলামে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সেহেতু সরকার তথা রাষ্টের টাকায় হজ করলে তা সঠিক বা শুদ্ধ হবে কি হবে না, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে৷ সরকারি টাকা মানে আসলে জনগণের করের টাকা, জনগণের কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকা অথবা জনগণের নামে বিদেশ থেকে আনা ঋণের বা অনুদানের টাকা৷ কাজেই, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা দিয়ে কাউকে হজ করতে পাঠানো হলে, তাতে টাকার প্রকৃত মালিক তথা জনগণের অনুমোদন থাকা বাঞ্ছনীয়৷
তবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার এসব টাকা সংগ্রহ ও ব্যয় করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত৷ সে বিবেচনায় সরকার এই টাকা থেকে কয়েকজনকে হজ করতে পাঠাতে পারে বলে ধরে নেয়া যায়৷ সেক্ষেত্রে জনগণকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে কারা হজ যাচ্ছেন৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে অনেকটাই স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে৷ হজ ব্যবস্থাপনার ওয়েব পোর্টালে হজ বিষয় সকল তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়৷
আবার যে কোনো সামর্থবান মুসলমান (যিনি আগে নিজে হজ করেছেন) আর্থিকভাবে যথেষ্ট সামর্থ নেই এমন আরেকজন মুসলমানকে হজ করার জন্য সহযোগিতা করতে পারেন, টাকা দিতে পারেন৷ এক্ষেত্রে যিনি হজ করবেন, তার পক্ষে এই অর্থ সহায়তা নিয়ে হজ করায় কোনো বাধা নেই বলে আলেমরা অভিমত দিয়েছেন৷ সে বিবেচনায় সরকারও কিছু মানুষের হজ করার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন বলে ধরে নেয়া যায়৷ কেননা, হজ সহায়তা দলে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের কারো কারোর নিজের টাকায় হজ করার সামর্থ নেই৷ তবে যাদের আছে, তাদেরকে কেন সরকারি খরচে যেতে হবে? এক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি অনেকটা এরকম যে তাদেরকে মূলত কিছু কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে, পাশাপাশি হজ করার সুযোগও করে দেয়া হচ্ছে৷
হজে বাংলাদেশের জন্য মোট হাজীর যে কোটা বরাদ্দ থাকে, হজ সহায়তা দলকে সেই কোটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হতে হয়৷ সেক্ষেত্রে এই দলের কিছু সদস্য সরকারি ব্যবস্থাপনার প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হন৷ বাকীরা সৌদি আরবে হজ স্টিকারধারী হিসেবে যান৷ স্টিকারধারীরা কাজের প্রয়োজনে মক্বা ও মদীনায় বারবার যাতায়াত করার অনুমিত প্রাপ্ত৷ আর শর্ত থাকে যে সৌদি সরকার শেষ পরযন্ত অনুমতি দিলেই তারা হজ করতে পারবেন৷ এতে করে অবশ্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করা আছে, এমন নাগরিকদের মধ্য থেকে কয়েকজন বাদ পড়ে যান হজ ভিসার কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায়৷ মানে হজ সহায়তা দল যতো বড় হয়, নিজ খরচে যেতে আগ্রহী ততোজন হজযাত্রী শেষতক বাদ পড়ে যান প্রত্যেক বছর৷
ঠিক কোন কোন মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে এই হজ সহায়তা দলের সদস্য নির্বাচন করা হয়, তা যথেষ্ট পরিস্কার নয়৷ একইভাবে প্রতিবারই হজ শেষে দেশে ফিরে হাজীরা অনেকেই দুর্ভোগ ও অনিয়মের বেশ কিছু অভিযোগ করে থাকেন৷ এসব অভিযোগের মধ্যে হজ সহায়তাকারী দলের কাছ থেকে ঠিকমতো সহযোগিতা না পাওয়ার বিষয়টিও থাকে৷ তাই এই হজ সহায়তা দলের কারযকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ হজযাত্রীদের সেবা বা সহায়তার ক্ষেত্রে এই দলের কোনো কোনো সদস্য একেবারেই নিস্ক্রিয় থাকেন৷ আবার অনেকে ভিআইপি প্রটোকলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ বিশেষত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা হজে গেলে সেখানেও ভিআইপি প্রটোকলসহ নানা সুবিধা প্রত্যাশা করেন এবং তা ঠিকমতো না পেলে অসন্তুষ্ট হন৷ সে কারণে হজ সহায়তা দলের কিছু সদস্যকে এদিকেই নজর রাখতে হয়ে৷
তাছাড়া যারা প্রথমবার হজের সময় মক্কায় যান, তাদের পক্ষে অনেককিছুই ঠিকমতো ঠাহর করা সম্ভব হয় না৷ আরবীতে মোটামুটি কথাবার্তা বলতে না পারলে বেশ সমস্যাই হয় বিশেষত সৌদি আরবের কর্মকর্তা, পুলিশ ও অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করতে৷ সারা দুনিয়া থেকে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে হজের সুবিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে তাল মেলানো খুব সহজ কাজও নয়৷
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ যার হজ করার নিয়ত কবুল করেন, শেষতক তারই হজে যাওয়া হয়৷ আর তাই যারা শেষ পরযন্ত হজে যাওযার সুযোগ পান, তারা আল্লাহর মেহমান হিসেবেই যান৷ এখানে আর্থ-সামাজিক অবস্থান, শ্রেণী-পেশা-পদবি সব গৌণ৷ ফলে নিজের খরচে হজে যাওয়ার পাশাপাশি যে অল্প কয়জন মানুষ সরকারি খরচে হজে যান, তাদের হজ পালন নিয়ে সমালোচনা করার আগে হয়তো আরেকটু ভাবা দরকার৷
সর্বোপরি, সরকারের দায়িত্ব হলো, হজের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যেন হজযাত্রীরা নির্বিঘ্নে হজে যেতে পারেন ও দেশে ফিরে আসতে পারেন৷ সরকারি খরচে হজে পাঠানোর ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার যেন এই পবিত্র ইবাদত নিয়ে জনমনে ভুল বোঝাবুঝি না হয়৷ হজ সহায়তা দল মক্কায় এক-দেড় মাস থেকে কী কী কাজ করেছে, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা যেতে পারে৷ এতে হজ সহায়তা দলের বিষয়ে বাংলাদেশি হাজীদের অভিমত ও অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে৷ ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই ধরণের হজ সহায়তা দল গিয়ে কিভাবে কাজ করে সে তথ্যও সংযোজন করা যেতে পারে৷