সিন্ডিকেট রুখবে কে?
২৭ আগস্ট ২০২২সরকারের দিক থেকেও এই সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়৷ কিন্তু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়না কেন?
ডিম সিন্ডিকেট ব্যাপক আলোচনা চলছে৷ আর আগে ভোজ্য তেল, চাল , পেঁয়াজ এমনকি আলুর সিন্ডিকেট নিয়েও ব্যাপক হইচই হয়েছে৷ সিন্ডিকেটের অভিযোগে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে থেকে চিঠি দিয়ে ভোজ্য তেল আমদানিকারকদের ডেকে কথাও বলা হয়েছে৷ কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি৷
সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করে:
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা গেছে সিন্ডিকেটের মূল কাজ হলোসরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা দেয়া৷ এটা করতে গিয়ে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেন এবং পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন৷ মূল কথা হলো বাজারে পণ্যের সরবারাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করা৷ বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে দিলেই দাম বেড়ে যায়৷ তবে এটা করতে হলে বাজারের বড় একটি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়৷ এটা আমদানি পণ্য এবং দেশি বিশেষ ধরনের পণ্য যা অল্প কিছু ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের পক্ষে করা সহজ৷
বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের ৯০ ভাগই আমদানি করা হয় এবং ছয়-সাতটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এই আমদানির সঙ্গে যুক্ত৷ চাল নিয়ন্ত্রণ করেন কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিকরা৷ তারাও সংখ্যায় বেশি নয়৷ আবার পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন হলেও একটি অংশ আমদানি করতে হয়৷ এই আমদানিকারকওরাও সংখ্যায় বেশি নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে যে ডিমের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল তার নেপথ্যে কী? ডিম তো আমদানি করা হয় না৷ আর বাংলাদেশে তো অনেক খামারি আছে৷
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘‘আমরা তো ক্ষুদ্র খামারি কিন্তু বাংলাদেশে ১০-১২টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আছে যারা মূল বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ তারাই প্রতিদিন সকালে ডিম, মুরগির দাম বেঁধে দেয়৷ তারা যে দাম বেঁধে দেবে সেই দামে বিক্রি করতে হবে৷ দুই সপ্তাহ আগে তারা এভাবে সিন্ডিকেট করে ৫১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে৷''
তার কথায়, কোনো অজুহাত পেলেই তারা এই কাজটি করে৷ এভাবে তারা বিভিন্ন সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমার ধারণা বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷ এতে আমাদের মত খামারিদের কোনো লাভ হয়না৷ ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়৷''
সিন্ডিকেট সবখানে:
গত মার্চে ভোজ্য তেলের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে৷ পেঁয়াজ ও চালের বাজার নিয়েও একই অভিযোগ৷ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘সিন্ডিকেটগুলো ভোগ্যপণ্যের সব খাতেই সক্রিয়৷ আর এখন সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে টেলি এবং অনলাইন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো সহজ৷ সারাদেশে একই সময়ে দাম বেড়ে যায়৷”
তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন, ‘‘ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে সেই বাড়তি দামের পেঁয়াজ দেশে আসার আগেই দাম বেড়ে যায়৷ আমদানিকারক হাতে গোনা৷ তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেন৷ আর পেঁয়াজ আসার আগে পুরনো পেঁয়াজের সরবরাহও কমিয়ে দেন নতুন দামে বেচার জন্য৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘চালের বাজার এখন চাতাল মালিক ছাড়াও কর্পোরেট গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে৷এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়৷ তবে তারা বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ চাল কিনে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে৷ তারই সুযোগ বুঝে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিপুল মুনাফা করেন৷ সরকার যে ভোজ্য তেল আমদানিকারকদের চাপের মুখে ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে সাত টাকা বাড়াল বাস্তবে এটা বাড়ানোর দরকার ছিলোনা৷ কারাণ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে এখনো তেলের দাম কম৷''
তার কথায়, ‘‘এখন ভোগ্যপণ্যের সব ধরনের ব্যবসা, আমদানি কর্পোরেট গ্রুপের হাতে৷ এখানে প্রভাবশালীরা জড়িত৷ কোনো কোনো ব্যবসায় সরকারের মন্ত্রীরাও আছে৷ ফলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনা বা ব্যবস্থা নেয় না৷ কিন্তু দেশে সিন্ডিকেট ও মজুতের বিরুদ্ধে আইন আছে, তবে তা প্রয়োগ করা হয় না৷ ''
সরকার কেন ব্যবস্থা নেয় না:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনেই মজুতদারি , সিন্ডিকেট, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ এই আইনে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সরকার কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? সরকারেই তো বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন৷ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তো সরাসরি ব্যবসা করেন৷ আর যারা সরকারে নেই তারাও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম৷ তাই সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে না৷ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়৷
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা ডিম নিয়ে যারা সিন্ডিকেট করেছে তাদের ডেকেছি৷ তাদের নিয়ে কাজ হচ্ছে৷ অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেখতে পাবেন৷ আর ভোজ্য তেল নিয়ে যারা সিন্ডিকেট করেছে তাদের তথ্য আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি৷ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷''
তবে তিনি বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশ নয় , সারা বিশ্বেই তো কর্পোরেট কালচার আছে৷ আমাদের এখানে ভোজ্য তেলের রিফাইনারি আছে আট থেকে ১০টি৷ তাদের একটি হয়তো বাজারের ২০ ভাগ সরবরাহ করে৷ এখন আমরা যদি মামলা করে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিই তাহলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে৷ তাই আমরা চেষ্টা করি আইনের মধ্যে থেকে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে৷ আমরা অভিযান চালাচ্ছি, জরিমানা করছি৷''
কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ডের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ ভোক্তা অধিদপ্তর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োহ করতে পারেনা৷ এটা জেলা প্রশাসক বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োগ করতে পারে৷ কিন্তু ওই আইন প্রয়োগের তেমন নজির নাই৷''