ভারতের সংসদে পাস হলো তিন তালাক বিল
২৮ ডিসেম্বর ২০১৭বৃহস্পতিবার সংসদের চলতি অধিবেশনে ‘মুসলিম ইউমেন (প্রটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ) বিল ২০১৭' আলোচনার জন্য পেশ করা হয়৷ জোরালো আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর কোনোরকম সংশোধনী ছাড়াই পাস হয়ে যায় বহুল আলোচিত তিন তালাক বিলটি৷ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড'-এর প্রতিবাদ সত্ত্বেও৷
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ আগেই জানিয়েছেন, ‘‘কোনো বিশ্বাস বা ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করার উদ্দেশ্য নেই সরকারের৷ বরং নারীর অধিকার, সুরক্ষা ও সম্মান বজায় রাখার উপরই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার৷'' বিলটি আইনে পরিণত হলে তাৎক্ষণিক ‘তিন তালাক' অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে৷ মুসলিম নারীরা এই নিয়ে আইনি লড়াই চালানোর সুযোগ পাবেন৷ তালাক যিনি দেবেন, তাঁকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে৷ এমনকি তিনবছর পর্যন্ত শাস্তি পেতে পারেন তিনি৷
বিজেপি-শাসিত সরকার যেভাবে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নিয়ে আসছে, তার নিন্দা করেছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম৷ তাঁর কথায়, ‘‘স্বামী দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে চলে গেলে স্ত্রী ও সন্তানদের শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, জা ইত্যাদির উপরেই তো নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে৷ সেক্ষেত্রে মহিলাকে অন্য এক দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে৷ সামাজিক এই ব্যাধি দূর করতে গিয়ে নতুন করে একটি সামাজিক সমস্যা তৈরি হবে৷ সামাজিক ক্ষেত্রে যে কোনো আইন তৈরি করতে হলে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করতে হয়৷ এক্ষেত্রে যেহেতু মুসলিম মহিলাদের বিষয়, তাই বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন৷ কারণ তাঁদের মধ্যে আগে সচেতনতা জরুরি৷’’ তিনি বলেন, ‘‘এমনিতে সমাজের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অংশে এর প্রভাব দেখা যায় না৷ দারিদ্রতায় পীড়িতদের মধ্যেই এই প্রথা দেখা যায়৷ এখন এর জন্য আইন করতে হলে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত৷ মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ‘তালাক' শব্দটা শোনেননি, তখন থেকেই বামপন্থিরা আন্দোলন করে আসছেন৷''
এদিকে খসড়া বিলটি প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড' বা এআইএমপিএলবি৷ বোর্ডের সচিব মৌলানা খালিদ সইফুল্লা রহমানির বক্তব্য, ‘‘বোর্ডও তিন তালাক প্রথার বিরোধী৷ এর জন্য কঠিন আইনের প্রয়োজন৷ তবে কেন্দ্রের আনা বিলের বর্তমান কাঠামো নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নয় বোর্ড৷ বিশেষ করে তিন বছরের শাস্তির বিষয়টিতে আমরা সহমত নই৷'' তাছাড়া খসড়া বিল তৈরিতে কোনো বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া হয়নি৷'' বলা বাহুল্য, আইন প্রণয়নের আগে মুসলিম ধর্মগুরুদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত বলে মনে করে বোর্ড৷
মুসলিম মহিলাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে কয়েক দশক ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ‘প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ', ‘রিফর্মিং মুসলিম সোসাইটি' এবং ‘সেকুলার মিশন'৷ এই সংগঠনগুলির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন অধ্যাপিকা তানবীর নাসরিন৷ প্রস্তাবিত আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ভারতের সমস্ত মুসলিমদের ঠিকা নিয়ে বসে নেই৷ মনে রাখতে হবে, ওরা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সরকারের এই পদক্ষেপকে আমার তো অত্যন্ত ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে৷''
সাধারণত দরিদ্র মুসলিম মহিলারা তিন তালাক প্রথার শিকার হন৷ এখন এই প্রথা রোধে আইন প্রণয়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মত উঠে এসেছে৷ গত আগস্টে তাৎক্ষণিক তালাককে ‘অসাংবিধানিক' ঘোষণা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷ পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ৩-২ ভোটে তিন তালাকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথাকে ‘অসাংবিধানিক', ‘অবৈধ' এবং ‘পরিত্যক্ত' আখ্যা দেয়৷ এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নেরও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত৷ তিন বিচারপতি ইউ ইউ ললিত, আর এফ নরিম্যান ও কুরিয়েন জোসেফ এই প্রথাকে ‘অসাংবিধানিক', ‘ইসলাম বিরোধী', ‘কোরান বিরুদ্ধ', ‘বে-আইনি' বলে মন্তব্য করেছিলেন৷ অন্যদিকে, প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিং খেহর ও বিচারপতি এস আবদুল নাজির তিন তালাক প্রথাকে অ-ইসলামি ঘোষণার বিরুদ্ধে ছিলেন৷ খেহর এবং নাজিরের মন্তব্য অবশ্য মানতে চাননি অপর তিন বিচারপতি৷
এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর তিন তালাক বিলে অনুমোদন দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা৷ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের পক্ষ থেকে সাজ্জাদ নোমানির অভিযোগ, ‘‘ল বোর্ড সংবিধানের রীতি মেনে সমস্যার সমাধান করতে পারে৷ আসলে কেন্দ্র মুসলিমদের হাত থেকে বিচ্ছেদ সংক্রান্ত নিয়মের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছেন৷''
মুসলিম সংগঠন অথবা অন্য কাদের সঙ্গে আলোচনা করে তিন তালাক বিল আনল সরকার? সংসদে সরকারকে এমনই প্রশ্ন করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ প্রসূণ ব্যানার্জি৷ আইনমন্ত্রী লিখিত জবাবে জানিয়েছেন, কারও সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি৷ বিল পেশের আগে প্রসূণ বলেন, ‘‘তিন তালাক মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত একটি প্রথা৷ সাধারণভাবেই মুসলিমরা ধর্মপ্রাণ হয়ে থাকেন৷ তাই স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে আইন তৈরির আগে সরকার পক্ষ ছাড়াও বিরোধী সব ক'টি রাজনৈতিক দল ও মুসলিম ধর্মের যে সংগঠণগুলি রয়েছে, তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসা উচিত৷ সেক্ষেত্রে ছোট-বড় ভাবলে চলবে না৷ অন্যথায় প্রস্তাবিত আইনের হাল ঠিক জিএসটি, নোট বাতিলের মতো অবস্থা হবে৷''
বিলটিতে বলা হয়েছে, মৌখিকভাবে কিংবা হোয়্যাটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ‘তিন তালাক' ঘোষণা আইনত নিষিদ্ধ৷ ফলে এভাবে তালাক যিনি দেবেন, তাঁকে ‘অপরাধী' হিসেবে গণ্য করা হবে৷ এছাড়া অপরাধীর তিন বছর কারাদণ্ড এবং মোটা অঙ্কের জরিমানার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে৷ ইতিমধ্যেই ভারতের একাধিক রাজ্য বিলটিকে সমর্থন জানিয়েছে৷
লোকসভার পর রাজ্যসভায় বিলটি পাস হলেই তা আইনে পরিণত হবে৷ ফলে দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে বিচার পেতে পারতেন মুসলিম মহিলারা৷ তবে বিলের খসড়া সামনে আসার পর থেকেই এ নিয়ে বিরোধিতা করছেন মৌলবীরা৷ শরিয়তি আইনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে৷ মৌলবীদের দাবি, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই বিলের স্বরূপ ঠিক করা উচিত৷ কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষের কারণেই বিজেপি সে পথ মাড়ায়নি৷ পরিশেষে সরাসরি সরকার বিরোধিতার পথেই হাঁটছে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড৷
বন্ধু, ‘তিন তালাক বিল’ নিয়ে আপনার অবস্থান কী? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷