পরিবর্তন জরুরি সব আইনেই
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭তাৎক্ষণিক তালাক নিয়ে মুসলিম সমাজের মেয়েদের এক বড় অংশের আপত্তি ছিল বহুদিন ধরেই৷ যে কারণে তিন তালাক নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের যে রায়, তাকে কোনো রাজনৈতিক দল, বা সরকার, অথবা বিশেষ কোনো ধর্মীয় মতবাদের জয় নয়, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের এক বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন সবাই৷ জরুরি কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে এই সূত্রে৷ সবথেকে বড় প্রশ্ন — সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে ধর্মীয় আইনের বিরোধ কোথায়? কেন এবং কী করলে সেই বিরোধ মিটিয়ে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো যাবে?
অধ্যাপিকা আফরোজা খাতুন অনেক দিন ধরে এই অন্যায় তালাকের শিকার হয়েছেন যেসব মহিলা, তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করছেন৷ তাঁদের সংগঠন ‘সাউথ ক্যালকাটা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন' একাধিকবার এমন মহিলাদের জনসমক্ষে হাজির করেছে, যাঁরা তালাক পেয়েছেন ফোনে, এসএমএসে, কিংবা চিঠিতে! ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পর ওঁরা কী ভাবছেন? আফরোজা ডয়চে ভেলেকে বললেন, ভারতের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো, এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের আইনগুলি যেমন ‘কোডিফায়েড', অর্থাৎ নথিভুক্ত, বিধিবদ্ধ, মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক আইনের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি৷ পুরোটাই মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে চলে আসছে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই মুখের কথা ব্যক্তিবিশেষে, প্রয়োজনের সাপেক্ষে, বা সুবিধামতো বদলে যায, যাচ্ছে৷''
আফরোজা খুব স্পষ্টভাষায় জানাচ্ছেন, প্রচলিত মুসলিম আইনে পুরুষ এবং নারীর সমানাধিকার নেই৷ নারীরা নানা ক্ষেত্রে, বিশেষত বিবাহবিচ্ছেদের প্রশ্নে বঞ্চিত, শোষিত৷ কাজেই সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই মেয়েদের কাছে একটা সুযোগ, নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করার৷ আফরোজা বলছেন, শরিয়তি আইনের তাই সংস্কার দরকার, যাতে মেয়েরা তাঁদের ন্যায্য পাওনাটা বুঝে নিতে পারেন৷ তার পর সেই আইন কোডিফাই করা দরকার, যাতে যে কারও মুখের কথাতে সেটা যথেচ্ছ বদলে না যেতে পারে৷
সাংবিধানিক আইন এবং ধর্মীয় আইনের মধ্যে এই একই বিরোধের জায়গা নির্দিষ্ট করলেন পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল, বিশিষ্ট আইনজীবী কিশোর দত্ত৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, বিচারবিভাগের কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু করার নেই, কারণ বিচারবিভাগ নতুন আইন তৈরি করতে পারে না৷ এই দায়িত্ব ভারতীয় সংবিধান দিয়েছে দেশের আইন সভাকে৷ তারা আইন তৈরি করবে, বিচারবিভাগ সেই আইন কার্যকর করার দায়িত্ব নেবে৷ তবে নতুন আইনের ক্ষেত্রে আরও একটা কর্তব্য আছে বিচারবিভাগের৷ আইনটি দেশের সংবিধান ও অন্যান্য আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা, এবং সেই অনুযায়ী আইনসভাকে মতামত জানানো৷
যেমন একটা অন্য উদাহরণ দিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল৷ বললেন ভারতে কোনো মামলা দায়ের করতে সরকারকে কোনো মাশুল বা কর দিতে হয় না৷ এবার আইনসভা যদি এমন একটা আইন আনে, যে কোনো মামলা করলেই সরকারকে একটা নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে, তাহলে বিচারবিভাগ খতিয়ে দেখবে যে সেই আইনটি অন্য কোনো আইন, বা সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি হচ্ছে কিনা৷ শরিয়তি আইন কোডিফাই হওয়ার ক্ষেত্রেও সেই একই ভূমিকা থাকবে বিচারবিভাগের৷ এবং আইনগুলি বিধিবদ্ধভাবে পাস হয়ে গেলে, সেগুলি কার্যকর করার দায়িত্ব নেবে বিচারবিভাগ৷ কোনো ক্ষেত্রে তার কোনো বিচ্যুতি, বা বিকৃতি ঘটছে কিনা, সেটা দেখার দায়িত্বও তখন বিচারবিভাগেরই৷
তবে কোনো আইন কোডিফাই হলেই যে সমস্যা মিটে যায়, তা নয়৷ এর একটা বড় কারণ, একমাত্র মুসলিম সমাজই যে পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষের স্বার্থ কেবল ইসলামি আইনেই বেশি রক্ষিত হয়, তা একেবারেই নয়৷ অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যের বিস্তর অভাব৷ যেমন হিন্দু সাক্সেশন অ্যাক্ট বা উত্তরাধিকার আইন, যার আওতায় শিখ, জৈন, বৌদ্ধরাও পড়েন৷ এই আইনে, একজন হিন্দু মহিলা ‘ইন্টেস্টেট', অর্থাৎ উইল, বা ইচ্ছাপত্র না করেই মারা গেলে, তাঁর সম্পত্তি পাবেন তাঁর স্বামী এবং ছেলে-মেয়েরা৷ মহিলা যদি বিধবা এবং নিঃসন্তান হন, তাহলে সেই সম্পত্তির ওপর প্রথম অধিকার তাঁর স্বামীর পরিবারের৷ সেখানেও যদি কোনো দাবিদার না থাকে, একমাত্র তবেই সম্পত্তি পেতে পারেন মহিলার মা, বাবা, কিংবা তাঁদের উত্তরাধিকারীরা৷ অর্থাৎ, স্বামীর পরিবারই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে৷ এই উত্তরাধিকার আইনের একটি ধারায় এমনও বলা আছে, যে কোনো মহিলা যদি তাঁর বাবা, অথবা মা, কিংবা দু'জনের থেকেই কোনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন আর তিনি উইল না করেই মারা যান, তাহলে তাঁর সব সম্পত্তির ওপর অধিকার বর্তাবে মহিলার বাবা বা বাবার উত্তরসূরিদের৷ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মায়ের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিও চলে যাবে বাবা বা তাঁর বংশধরদের কাছে৷ প্রসঙ্গত, বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে এখানে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়নি৷
বিভিন্ন মামলার সূত্রে অবশ্য এই আইনগুলি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং সেই সূত্রে আইনের সংস্কারও হয়৷ যেমন হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে একসময় বিবাহিত মহিলারা বাবা, বা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পেতেন না৷ মামলায় সেই নিয়ম চ্যালেঞ্জ করার পর আইন বদলেছে৷ কিন্তু আইনজীবীরা বলছেন, বিচারবিভাগ কোনো আইন বদলের পরামর্শ দিতে পারেন মাত্র৷ পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল যেমন পরিষ্কারই বললেন, কোনো মামলার রায় দিতে গিয়ে আদালত যখন আইনের মতো কিছু বলে ফেলেছে, অর্থাৎ এমন কিছু বলেছে, যা আইনের মতো শুনিয়েছে — সেটা সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ কারণ সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগ আইন রক্ষা যেমন করে, সেই আইনের কোনো বিচ্যুতি ঘটল কিনা, তারও খেয়াল রাখে৷ কিন্তু নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারে না৷
ফলে সবসময়ই নারী-পুরুষের অধিকারে ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয় বিবাহ, বিচ্ছেদ বা খোরপোষ সংক্রান্ত আইনে, যা হয়ত আদ্যিকালের আইন, কিন্তু এখনও চলে আসছে, কোনো সংস্কার ছাড়াই৷ যেমন ভারতীয় বিবাহবিচ্ছেদ আইনে, বিবাহ-বিচ্ছিন্ন মহিলা শুধুমাত্র সেই সম্পত্তি দাবি করতে পারবেন, যা বিবাহের সময় বা তার পরে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানায় ছিল৷ এবার এখানেও সেই পুরুষতন্ত্রের দাপট যে ভারতে শহরাঞ্চলের বাইরে সমস্ত ধরনের সম্পত্তিই কেনা হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নামে৷ সেই খরিদ্দারিতে যদি বাড়ির মহিলাদের কোনো আর্থিক অবদান থাকেও, সেটা মালিকানার কাগজপত্রে নথিভুক্ত হয় না৷ ধরা যাক স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে স্বামীর জমি বা বাড়ি কেনা এবং সেই সম্পত্তি প্রথাগতভাবে স্বামীর নামে রেজিস্টার্ড হওয়া৷ সম্ভাব্য বিবাহবিচ্ছেদের সময় কিন্তু, আইনের চোখে, স্ত্রীর কোনো অধিকারই থাকবে না ঐ সম্পত্তিতে৷ বিবাহবিচ্ছেদের আইনের ক্ষেত্রেও অসংখ্য ধারা আছে, যা মূলত দেখা হয়েছে সেই ভিক্টোরিয়ান আমলের নীতিশিক্ষা এবং মূল্যবোধের চশমা পরে৷ সময় এবং সমাজ যে তার পরে অনেক বদলেছে, তার কোনো ছাপ সেই তামাদি আইনে নেই৷
সুতরাং তাৎক্ষণিক তালাকের ক্ষেত্রে যেমন মুসলিম মেয়েরাই পথে নেমে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, চাপ দিয়েছেন সরকারকে, তেমনই অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রেও একই সচেতনতার প্রসার এবং জনমানসে বিতর্কের পরিসর তৈরি হওয়ার দরকার আছে৷ যেহেতু বৈষম্য, ভারসাম্যের অভাব আছে সব ক্ষেত্রেই৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷