ভারতে ‘তিন তালাক’ বিতর্ক
১৫ মে ২০১৭‘তালাক, তালাক, তালাক৷’ একটি শব্দের তিনবার মৌখিক উচ্চারণ৷ ব্যাস, সম্পর্ক শেষ! স্বামী তাঁর মর্জি মাফিক স্ত্রীর উদ্দেশ্যে ‘তালাক' বললেই মুহূর্তেই ছিন্ন হয়ে যায় বৈবাহিক সম্পর্ক৷
বিবাহ থাকলে বিবাহবিচ্ছেদও থাকবে৷ সেটাই স্বাভাবিক৷ তাই বলে, এক তরফা কেন? স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সহমতের ভিত্তিতে যদি বিবাহ হয়, তবে একই ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হবে না কেন? তাছাড়া বিচ্ছেদের পর বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী এবং তাঁর সন্তান-সন্ততির আর্থিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব (ভরণ-পোষণ) কেন নেবে না স্বামী? তাছাড়া শরিয়তি এই আইনের আরো একটা কুৎসিত দিক রয়েছে৷ তালাকের পর যদি স্বামী আবার ফিরিয়ে নিতে চান তাঁর স্ত্রীকে, তাহলে সেই স্ত্রীকে আগে কিছুদিন ‘পর পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে’ আসতে হবে৷ এইসব আইন, নিয়ম ও প্রথার পেছনে কি শুধুই লুকিয়ে রয়েছে ধর্মীয় কারণ? নাকি, তার আড়ালে নিজেদের সুবিধামতো চুপিসাড়ে নারীদের অসহায় করে রাখার এক মরণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক মুসলিম সমাজ?
যুগ যুগ ধরে এত শত প্রশ্নমালা নিজেদের অন্তরের অন্তর্স্থলে লুকিয়ে রেখেছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীরা৷ এখন যা অনেকটাই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে৷ যাঁরা সাহস যোগাচ্ছেন, তাঁরা মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে ভুক্তভোগী কিছু মানুষ৷ প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ, রিফর্মিস্ট মুসলিম সোসাইটি, সেকুলার মিশন-সহ কয়েকটি সংগঠনের তরফে ‘যৌথ মঞ্চ’ তৈরি করে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ এটা তাঁদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই৷ প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিং খেহর থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি পর্যন্ত ছুটে গেছেন আন্দোলনকারী মুসলিম নারীরা৷
একাধিক প্রগতিশীল মুসলিম সংগঠনকে এক ছাতার তলায় এনে মুসলিম নারীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন তনবীর৷ নিজে একজন মুসলিম নারী হয়েও মুসলিম সমাজের এই ‘কু-প্রথা’ থেকে সমাজকে বের করে আনতে চাইছেন তিনি৷ তবে এ জন্য তিনি কোনোভাবেই পবিত্র কোরান এবং ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করতে নারাজ৷ তাঁর কথায়, ‘‘তিন তালাক একটি সামাজিক ব্যাধি৷ এর ফলেই নারী পাচারের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাগুলিতে৷ সেখানে ১২-১৪ বছরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়৷ ১৭ না হতেই তালাক৷ তারপর অনেকেই ‘হিউম্যান ট্র্যাফিকিং’-এর শিকার হয়৷ এটা শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের ওপরেই প্রভাব ফেলে না৷ গোটা সমাজ এবং দেশের সর্বনাশ হয়৷ বিশ্বের মুসলিম অধ্যুসিত ২২টি দেশে তালাক নিষিদ্ধ৷ তিন তালাকের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই৷ কোরানে কোথাও এই ভাবে মৌখিক তালাক দেওয়ার উল্লেখ নেই৷ তাছাড়া যাঁরা কোরান ও ইসলামের দোহাই দিয়ে তিন তালাক প্রথা অটুট রাখার দাবি তুলছেন, তাঁরা কোরানে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ নেন? কোরানে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কেন মদ্যপান করেন? ইসলামে হারাম হওয়া সত্ত্বেও কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্বী পোস্ট করেন? আসলে সবটাই নিজেদের সুবিধা মতো গুছিয়ে নিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ৷ মুসলিমরাও তার বাইরে নয়৷ ফলে এখন আমরা আশাবাদী যে, সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অন্যায় ‘তালাককে’ অবৈধ ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করবে৷ যদি তেমনটা হয়, সেটাই হবে ভারতে মুসলিম নারী জাগরণের প্রথম পদক্ষেপ৷ এরপর মুসলিম নারীদের সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরির অধিকার আদায় করতে হবে৷’’
তিন তালাক মামলার শুনানি চলছে সুপ্রিম কোর্টে৷ শেষতম শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘মুসলিম সমাজে তিন তালাক প্রথা বিবাহ বিচ্ছেদের একটি ‘জঘন্যতম’ ও বে-আইনি ব্যবস্থা৷’’ এর আগে, তিন তালাকের বৈধতা খুঁজতে গিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত মূলত সংবিধানে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ এবং মুসলিম ধর্মে মৌখিক ডিভোর্সের এই প্রথাটি আদৌ মুসলিম ধর্মের মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল৷ বাদ রাখা হয়েছে বহু বিবাহের মতো বিষয়টি৷ শুনানি শুরু হতেই প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, ‘‘মুসলিম ধর্মের মৌলিক অধিকারগুলির আওতার মধ্যে আদৌ ‘তিন তালাক’ বিষয়টি পড়ে কিনা, তার সমস্ত দিক বিবেচনা করে দেখা হবে৷ কিন্তু এই মামলার সঙ্গে ‘বহু বিবাহ’ বিষয়টির কোনো সম্পর্ক নেই৷’’ সাংবিধানিক বেঞ্চের এহেন মন্তব্য আসলে প্রবীন আইনজীবী, কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সলমন খুরশিদের একটি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে৷ তার আগেও বিচারপতিরা মন্তব্য করেন, ‘‘মুসলিম সমাজের একটা অংশ মনে করে, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য তিন তালাক প্রথা সম্পূর্ণ বৈধ৷ কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের এই প্রথাটি জঘন্যতম৷ এই প্রথা মেনে নেওয়া যায় না৷’’ যদিও সলমন খুরশিদ আদালতকে বলেন, ‘‘তালাকের ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় অনুসন্ধানের কোনো প্রযোজন নেই৷ তাছাড়া মুসলিম মহিলারা ‘নিকাহনামা’-তে (বিবাহ চুক্তি) একটি শর্ত যোগ করে তিন তালাককে ‘না’ বলতেই পারেন৷’’ এরপর আদালত কক্ষে সলমন খুরশিদের সঙ্গে তুমুল বিতর্ক জড়িয়ে পড়েন আর এক প্রবীণ আইনজীবী রাম জেঠমালানি৷ এই সাংবিধানিক বেঞ্চের প্রত্যেক সদস্যই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের৷ এঁরা হলেন, প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিং খেহর (শিখ), বিচারপতি কুরিয়ান জোসেফ (খ্রিষ্টান), বিচারপতি রোহিংটন ফালি নারিমান (পার্সি), বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত (হিন্দু) এবং বিচারপতি এস আবদুল নাজির (মুসলিম)৷
পূর্ব মেদিনীপুরের কুলবেড়িয়া ভীমদেব আদর্শ বিদ্যাপীঠের সহকারি শিক্ষিকা শালিমা হালদারও তিন তালাকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল৷ ওঁর মতে, ‘‘তালাক প্রথাটা অমানবিক, অসাংবিধানিক৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার থাকা উচিত৷ তাহলে তালাক দেওয়ায় কেন পুরুষের একছত্র অধিকার থাকবে? আমি চাই, এই প্রথা উঠে যাক৷ নয়ত নারীদেরও তালাক দেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক৷’’ তালাক পরবর্তী সমস্যা নিয়েও চিন্তিত শালিমা৷ বললেন, ‘‘একবার তালাক দেওয়ার পর আবার যদি স্বামী-স্ত্রী পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যেতে চায় তাহলে এক জঘন্য প্রথা মানতে বাদ্য করা হ্য় সেটা হল, স্ত্রীর সঙ্গে অন্য কোনো পুরুষের নিকাহ দিতে হবে৷ এবং সেক্ষেত্রে সেই পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতেই হবে৷ তারপর সেই পুরুষ তালাক দিলে পুরোনো স্বামীর সঙ্গে নিকাহ হতে পারবে৷ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ইচ্ছেখুশি তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ৷ ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ প্রথা কেন নিষিদ্ধ হবে না?’’
একটি প্রগতিশীল মুসলিম সংগঠনের হয়ে এই প্রথার বিরোধিতা করছেন আর এক প্রবীন আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং৷ আদালতে তাঁর সওয়াল, ‘‘বিবাহে যদি মহিলার সম্মতির প্রয়োজন হয়, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদে একতরফা সিদ্ধান্ত হয় কি করে?’’ তাই এই প্রথাকে তিনি শুধু অসাংবিধানিক আখ্যা দেননি, পাশাপাশি ‘বিচার ব্যবস্থার আয়ত্তের বাইরের কোনো আইন’ বলে অভিহিত করেছেন৷ তিন তালাককে একজন মহিলার ‘সামাজিক মৃত্যু’ বলে বর্ণনা করেছেন ইন্দিরা৷ তাঁর কথায়, ‘‘দেশের কোনো ব্যক্তিগত আইন সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করতে পারে না৷ তা সে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মের আইনই হোক না কেন৷’’
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মুসলিম নারীদের তালাকের উৎপীড়ন সহ্য করতে দেখেছেন নাজিনা৷ তাঁর এক আত্মীয়ার তালাকের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন৷ শিউরে উঠতে হয় সেকথা শুনে৷ বলছিলেন, ‘‘পারিবারিক ঝগড়ার কারণে একদিন আচমকা স্বামী তালাক দিলেন৷ তারপর কয়েক বছর দুঃসহ যন্ত্রণায় দিন যাপন সেই স্ত্রীর৷ কিছুদিন পরে একদিন স্বামী-স্ত্রী ঠিক করলেন তাঁরা আবার একসঙ্গে ঘর বাঁধবেন৷ কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল সমাজ৷ মৌলবিরা নিদান দিলেন, নতুন করে ঘর বাঁধার আগে স্ত্রীকে আবার অন্য কারও সঙ্গে নিকাহ দিতে হবে৷ বাধ্য তা-ই করতে হলো৷ নিজের নন্দাইয়ের সঙ্গে প্রথা মাফিক নিকাহ হলো৷ সাড়ে তিনমাস তাঁরা একসঙ্গে রইলেন৷ তারপর ‘নিকাহ হালাল’-এর মাধ্যমে পুরোনো স্বামী-স্ত্রী আবার ঘর বাঁধলেন৷’’
মামলা আদালতে উঠতেই সব পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলে দিয়েছেন, ‘‘তিনটি বিষয় বলার আছে৷ এক, ‘তিন তালাক’ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য বিষয় কিনা, যদি মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য হয়, তবে দেখতে হবে, সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি কিনা৷ দুই, এই প্রথা ওই ধর্মের সংস্কারমূলক প্রথা কিনা৷ এবং তিন, সংবিধানের কোনো প্রয়োগযোগ্য মৌলিক অধিকার এই প্রথার ফলে লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা৷’’
আদালতের অনুরোধে এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টকে সাহায্য করছেন সলমন খুরশিদ৷ প্রধান বিচারপতি খুরশিদের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘‘ভারতের বাইরে তিন তালাকের অস্তিত্ব আছে?’’ জবাবে খুরশিদ বলেন, ‘‘নেই৷ অনেক মুসলিম দেশেই তিন তালাক নিষিদ্ধ৷’’ এরপর তাঁকে বিশ্বের সমস্ত মুসলিম এবং অ-মুসলিম দেশ গুলিতে তিন তালাক নিয়ে কী নিয়ম আছে, তার একটি তালিকা জমা দিতে বলেন প্রধান বিচারপতি৷ যদিও আগেই মামলাকারীদের পক্ষে আদালতকে জানানো হয়েছে, মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মরক্কো এবং সৌদি আরবের মতো দেশেও তিন তালাকের বৈধতা নেই৷ তিন তালাক প্রথার তীব্র নিন্দা করেন রাম জেঠমালানি৷ তিনি এক ভুক্তভোগী মুসলিম মহিলার হয়ে মামলা লড়ছেন৷ এদিন আদালতে তিনি বলেন, ‘‘তিন তালাকের অধিকার যেহেতু শুধুমাত্র মুসলিম পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফলে এই প্রথা দেশের সংবিধানের ১৪ নং ধারার পরিপন্থি৷ যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে৷’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তিন তালাকে লিঙ্গবৈষম্য স্পষ্ট, যা পবিত্র কোরানের কোথাও উল্লেখ নেই৷ একজন বৈধ স্ত্রী শুধু তাঁর স্বামীর কথাতেই প্রাক্তন হয়ে যাবেন, এটা হতে পারে না৷ এখানে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে৷ তাই এই আইনের পক্ষে সওয়াল করাটাই অর্থহীন৷’’ প্রধান বিচারপতি খেহরের প্রশ্ন, তিন তালাক কি শুধুমাত্র প্রতীকী আচরণবিধি, নাকি ধর্মের মৌল আচরণবিধির মধ্যেও পড়ে? কোনো পাপ বা অন্যায় প্রথা কি শরিয়তের অংশ হতে পারে? জবাব এখনও মেলেনি৷
তবে আপনারা কী বলেন? লিখুন নীচের ঘরে৷