শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়া
১৮ জানুয়ারি ২০১৬ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলেছেন এমরানুল হক চৌধুরী৷ বাংলাদেশে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ২৬৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফোরামের নাম ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম'৷ এমরানুল হক চৌধুরী সেই ফোরামেরই চেয়ারপার্সন৷
ডয়চে ভেলে: স্কুলে তো এখন সব ধরনের শাস্তিই নিষিদ্ধ৷ তারপরও এই মুহূর্তে বাংলাদেশে পরিস্থিতি কেমন?
এমরানুল হক চৌধুরী: আমরা যদি তুলনা করি, ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে শিশুদের শারীরিক নির্যাতন আর এখনকার শারীরিক নির্যাতন, তাহলে দেখা যাবে যে এখন শাস্তির ধরনটা পাল্টে গেছে৷ আগে স্কুলে সাধারণত যে ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো, সেগুলো হলো – বেত দিয়ে মারা, কান ধরে উঠ-বস করানো, থাপ্পর দেয়া অথবা ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা৷ শিক্ষক তাঁর পাঠদানের পাশাপাশি শাস্তি দেয়াটাকেও একটা কাজ হিসেবে নিতেন৷ তখন প্রত্যেক স্কুলে বেত কেনার জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ দেয়া হতো৷ এখন এই বিষয়টা নেই৷ কিন্তু নির্যাতনটা অন্যভাবে বেড়ে গেছে৷ আমরা যদি আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার দিতে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে সাড়ে ৩ বছরের একটি শিশুকে কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি করা হচ্ছে আথবা ক্লাস টু-থ্রিতে বইয়ের যে বহর...৷ আমাকে ক্লাস থ্রি-র একটি শিশু বলেছিল যে, তার ৩৯টা বই৷ এখন সেই শিশুটিকে যদি ৩৯টা বই পড়তে হয়, তাহলে এটা তো এক ধরনের নির্যাতন৷ মানসিক নির্যাতন তো বটেই, শারীরিক নির্যাতনও৷ এই বইগুলো যদি তাকে রপ্ত করতে হয়, তাহলে সে শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে যাবে৷ তাই আমি বলবো, স্কুল বা পাঠশালাতে নির্যাতনের ধরনটা বদলেছে, কিন্তু নির্যাতন কমেনি৷
আপনাদের যে শিশু অধিকার ফোরাম, সেখান থেকে আপনারা এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেন বা কাজ করেন? আসলে আপনাদের ভূমিকাটা কী রকম?
আমাদের শিশু অধিকার ফোরামের সদস্য যারা, তারা শিশু নির্যাতন বন্ধের জন্য অনেক ধরনের কাজ করেন৷ বড় ধরনের কিছু হলে আমরা ‘ক্যাম্পেইন' করি৷ মানে ‘অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন'৷ সেখানে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়৷ বছরের বিভিন্ন দিনে জনগণকে শিশু নির্যাতন বিষয়ে জানানো, শিশু নির্যাতন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কী ধরনের ‘পলিসি', শিশু নির্যাতন বন্ধের জন্য কী ধরনের আইন রয়েছে দেশে, আন্তর্জাতিক আইনগুলোই বা কী কী, এ বিষয়ে কনভেনশনগুলো কী রয়েছে – এ সব সম্পর্কে সেমিনার সভার আয়োজনো করে থাকি আমরা৷ একেবারে গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সদস্যরা কাজ করেন৷ এছাড়াও আমরা সমাজের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নানারকম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাই৷ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসি, তথ্যগুলো তাঁদের সরবরাহ করি৷ কিভাবে নির্যাতন হচ্ছে, গোটা বাংলাদেশের শিশু নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি আমরা প্রতি মাসে সরকারের ‘পলিসি মেকার' যাঁরা বা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাঁরা, তাঁদের কাছে নিয়ে যাই৷
শিশু নির্যাতিত হলে তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে৷ সেক্ষেত্রে আপনারা কি আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আমরা অনেক ব্যবস্থা নিয়েছি৷ এই মুহূর্তে হয়ত সংখ্যাটা বলতে পারব না৷ তবে মূলত আমরা দু'টি জিনিস করি৷ কোনো জায়গায় যদি শিশু নির্যাতন হয়, আমাদের সদস্য সংগঠনের লোকজন তখন সেখানে চলে যায়৷ যেমন যখন রাজন বা রাকিব হত্যাকাণ্ড হলো, তখন সেখানে আমাদের সদস্য সংগঠনগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে৷ তারা ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কিন্তু লেগে ছিল৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের সদস্য সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ এলাকায় প্রতিনিয়ত ‘মনিটরিং' করছে৷ তারা সেগুলো লিপিবদ্ধ করে আমাদের হেডকোয়ার্টারে পাঠায়৷ এছাড়া আইনগত ক্ষেত্রে আমরা যেটা করি, সেটা হলো আমরা পুলিশকে অবহিত করি৷ প্রয়োজনে যারা নির্যাতন করছে তাদের পুলিশের কাছে নিয়ে যাই৷ অনেকক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ কিছু সংস্থা আছে, যারা বিনা পয়সায় আইনগত সহায়তাও দেয়৷ তাছাড়া সরকারের একটি ফান্ডও আছে৷ আমরা ডিসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গরিব মা-বাবার শিশু হলে তাদেরও সহায়তা দেই৷
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া বা তাদের উদ্বুদ্ধ করা – এই ধরনের কোনো কর্মসূচি কি আপনাদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়?
হ্যাঁ, এ ধরনের কর্মসূচিও আমাদের আছে৷ শিশুদের স্কুলে ‘কর্পোরাল পানিশমেন্ট' দেয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের ‘ডাইরেকটিভ' আছে৷ এই ‘ডাইরেকটিভ'-এর কপি আমরা বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় গোটা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি স্কুলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছি৷ ‘ডাইরেকটিভ'-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, শিশুদের ‘কর্পোরাল পানিশমেন্ট' শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কি মনে করেন মারধর করে সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়? আপনার উত্তর জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...