‘শিক্ষকের অপমান, সবার অপমান’
১৭ মে ২০১৬গত ১৩ মে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির গুজব ছড়িয়ে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করার শাস্তি দেয়া হয়৷ স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নিজে উপস্থিত থেকে এই শাস্তি কার্যকর করেন৷
বাস্তবে কিন্তু এই প্রধান শিক্ষক ধর্ম নিয়ে কোনো কটুক্তি করেননি৷ কয়েকদিন আগে তিনি স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে দৈহিক শাস্তি দেন৷ সে ঘটনাকে ইস্যু করেই স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে তাঁর বিরোধী গ্রুপের সদস্যরা ধর্ম নিয়ে কটুক্তির গুজব ছড়ায়৷
ঘটনার দিন এলাকার মজজিদ থেকে মাইকে এই গুজব প্রচার করা হয়৷ এরপর লোকজন জড়ো হলে শিক্ষককে মারধোর করা হয়৷ তারপর সাংসদ সেলিম ওসমান গিয়ে শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বসের শাস্তি দেন এবং তা কর্যকর করেন৷
এই ঘটনার ছবি এবং খবর সংবাদমাধ্যম হয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়৷ শিক্ষা মন্ত্রণালায় এরইমধ্যে ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে৷ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘‘আমি লজ্জিত, আমি দুঃখিত৷ শিক্ষক অবমাননাকারীদের শাস্তি পেতে হবে৷'' কিন্তু ঘটনার পর চারদিন পেরিয়ে গেলেও কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি৷ আজও বহাল তবিয়তে আছেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান৷
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষকের এই অবমাননা আমাদের জন্য লজ্জার৷ তাঁকে অবমাননা আমাদেরই ছোট করেছে৷ তদন্ত কমিটি কবে প্রতিবেদন দেবে আর কবে শাস্তি হবে! যারা অপরাধ করেছেন তাদের ছবি আছে, ভিডিও আছে৷ তা দেখেই শাস্তি দেয়া হোক৷''
তিনি জানান, ‘‘একজন সংসদ সদস্যের সামনে শিক্ষককে এই শারীরিক শাস্তি আমাদের বলে দেয় যে, সমাজ এখনো শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখছে না৷ সমাজপতিরা শিক্ষকদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করেন না৷''
তাই অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, ‘‘শিক্ষকদের যদি এভাবে অপমানজনক শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে তা আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই অশনিসংকেত৷ শিক্ষদের সম্মান না থাকলে তাঁরা শিক্ষিত জাতি কিভাবে গড়ে তুলবেন?''
তাঁর কথায়, ‘‘তিনি যদি কোনো ছাত্রকে ক্লাসে মেরে থাকেন, তার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থার বিধান আছে৷ তা না করে উল্টে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে সংসদ সদস্যের উপস্থিতে তাঁকে যে শাস্তি দেয়া হলো, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এই ঘটনা নিন্দনীয়৷ শিক্ষককে অবমাননাকারী সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো প্রভাবশালী – যে-ই হোক না কেন, তাদের শাস্তি দিতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজ শিক্ষকদের সম্মান করতে শিখিয়েছে, এটা বজায় রাখতে হবে৷ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কারণে তার অন্যথা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি না৷ শিক্ষকরা সম্মানের আসনেই আছেন এবং থাকবেন৷''
ঘটনায় আলোচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান অবশ্য ঘটনার ঠিক পর পর সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না৷'' তবে মঙ্গলবার ডয়চে ভেলের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি৷
এদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে ‘সরি স্যার' হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে শিক্ষক অবমাননার প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে৷ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই হ্যাশট্যাগে নিজেরা কান ধরে সেই ছবি তুলে ‘পোস্ট' করছেন৷
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, শ্যামল কান্তি ভক্তকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছেে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি আজ (মঙ্গলবার) বরখাস্তের চিঠি পেয়েছি৷ স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলাম ১৬ মে বরখাস্তের আদেশে সই করেছেন৷’’
প্রসঙ্গত, চিঠিটি প্রস্তুত করা হয়েছে ১৩ মে, অর্থাৎ অবমানার দিনই৷ সাময়িক এই বরখাস্তের আদেশে চারটি কারণ দেখানো হয়েছে – ছাত্রদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ গ্রহণ, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য, ছুটি না নিয়ে বিদ্যালয় থেকে অনুপস্থিত থাকা এবং সময়মতো বিদ্যালয়ে না আসা৷ এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কোনো বক্তব্য জানা যায়নি৷
বন্ধু, আপনার জীবনে কি কোনো শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা আছে? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷