শয্যা নেই, 'রেফার' রোগে বাড়ছে রোগীর হয়রানি
১২ ডিসেম্বর ২০২৩রোগীর তুলনায় শয্যার সংখ্যা কম। এর ফলে মরণাপন্ন রোগীকেও ভর্তি করাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। তার উপর কেন দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গের সেরা হাসপাতাল এসএসকেএমে থাকছেন, তা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে।
হয়রান বিধায়ক
মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ঘিরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা যায়। এমনই অভিজ্ঞতা মুখে নদিয়ার চাকদহের বিজেপি বিধায়ক বঙ্কিম ঘোষ। তিনি এক যুবককে ভর্তি করাতে এসে কয়েকদিন ধরে ঘুরছেন এসএসকেএমে।
বিজেপির যুবকর্মী ৩২ বছরের মিলন বিশ্বাস ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত। জেলায় চিকিৎসা না হওয়ায় তাকে 'রেফার' করা হয় কলকাতায়। শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালে ইতিমধ্যেই বিল ১০ লক্ষের আশেপাশে পৌঁছেছে বলে দাবি পরিবারের। এই পরিস্থিতিতে মিলনকে এসএসকেএমে ভর্তি করানোর উদ্যোগ নেন বিধায়ক।
কিন্তু যুবককে এখানে ভর্তি করাতে বেগ পেতে হচ্ছে বিধায়ককে। বঙ্কিমের বক্তব্য, "আমি একজন জনপ্রতিনিধি। আমাকেই যদি এখানে এভাবে ঘুরে বেড়াতে হয়, তা হলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা! কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরও কাজ হয়নি।"
এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের দাবি, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আসা রোগীর জন্য আইসিইউয়ে আট শতাংশের মতো শয্যা বরাদ্দ থাকে। আবেদনের ভিত্তিতে পরপর শয্যা দেয়া হয়। বিধায়কের আবেদন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কোনো রোগীকে শয্যা থেকে সরিয়ে জায়গা করে দেয়া সম্ভব নয়।
শয্যা অমিল
গত শনিবার এক রোগীর মৃত্যু ঘিরে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। হাওড়ার বাসিন্দা আকলিমা বিবিকে শুক্রবার 'রেফার' করা হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। এখানে শয্যা মেলেনি। তাকে 'রেফার' করা হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেও একই পরিস্থিতি।
ফের আকলিমাকে নিয়ে এসএসকেএমে আসেন পরিজনরা। আউটডোরে দেখানো হলে চিকিৎসক জানান, ভর্তির প্রয়োজন নেই। পরিবারের দাবি, এরপর বাড়ি ফেরার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন আকলিমা এবং তার মৃত্যু হয়।
শুধু এসএসকেএম নয়, কলকাতার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে মাঝেমধ্যেই রোগী ভর্তি নিয়ে এমন সমস্যা নজরে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে ছুটে বেড়ায়।
শাসক শিবিরে ক্ষোভ
তৃণমূল বিধায়ক ও রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী মদন মিত্র এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন। কিছুদিন আগে এক রোগীকে ভর্তি করতে এসে তিনিও নাকাল হন। ক্ষোভে মদন বলেছিলেন, 'সে নো টু পিজি'। এখন এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন মদন সপ্তাহ দুয়েক আগে এসএসকেএমে 'দালালরাজ' নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন।
বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ের মুখে একই ধরনের অভিযোগ শোনা গিয়েছে। রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে রোগীকে ভর্তি করাতে পারেননি তিনি। শতাব্দীর বক্তব্য, "হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সদুত্তর না মেলায় রোগীকে নার্সিংহোমে ভর্তি করাতে হয়।" তিনি বঙ্কিম ঘোষের মতোই বলেছেন, "জনপ্রতিনিধির এই অবস্থা হলে আমজনতার কী হবে?"
শুধু ভর্তি নয়, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রশ্ন তুলেছেন। বিদেশ সফর পায়ে চোট পান মুখ্যমন্ত্রী। গত অক্টোবরে তার চিকিৎসা হয় এসএসকেএমে। তিনি পরে বলেন, "আমার ইনফেকশনটা সেপটিক টাইপের হয়ে গিয়েছিল ভুল চিকিৎসার জন্য।"
'রেফার' রোগ
জেলা থেকে যথেচ্ছ রোগীদের 'রেফার' করা হচ্ছে বলে সমস্যা বাড়ছে বলে অনেকের মত। এই সমস্যা কাটাতে স্বাস্থ্যভবন দুটি তালিকা জারি করে বলে, কোন চিকিৎসা জেলায় করা হবে ও কোনটি কলকাতায় করা জরুরি। যদিও 'রেফার'-এর প্রবণতা রয়ে গিয়েছে।
এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ও তৃণমূল বিধায়ক ডা. সুদীপ্ত রায় বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে এখন উন্নত চিকিৎসা মিলছে। তাই প্রচন্ড ভিড় হচ্ছে। এসএসকেএমে আউটডোরে রোজ ১০ থেকে ১২ হাজার রোগী আসেন। ভর্তিযোগ্য সব রোগীর জন্য বেডের সংকুলান করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের পরিসর বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই জেলার হাসপাতালগুলিকে উন্নত করার চেষ্টা চলছে।"
সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. সজল বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জেলা হাসপাতালে সব রোগের চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই। তাই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, নইলে প্রয়োজনে রেফার করতেই হবে। রোগীকে তো আর জেলায় রেখে মেরে ফেলা যায় না! পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও রেফার হলে খতিয়ে দেখা দরকার।"
রাজনৈতিক 'আশ্রয়'
বিরোধীরা হাসপাতালের 'রাজনৈতিক ব্যবহার’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র এসএসকেএমে ভর্তি রয়েছেন। তাকে কেন শিশুদের জন্য বরাদ্দ কার্ডিওলজির শয্যা দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন কর্তৃপক্ষ।
বঙ্কিম ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সুজয়কৃষ্ণের মতো দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা আশ্রয় পাচ্ছেন হাসপাতালে। প্রকৃত রোগীদের বঞ্চিত করে তাদের বেড দেয়া হচ্ছে।’’ শাসক শিবিরের মতে, চিকিৎসার প্রয়োজনে কাউকে আইসিইউতে রাখা হতেই পারে।
ভদ্র যখন শিশুদের শয্যায়, সে সময় খবর আসে, মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ২৪ ঘন্টায় নয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সেখানে শিশু রোগীর প্রচুর চাপ। এই শিশুদের একজন কি এসএসকেএমের শয্যায় ঠাঁই পেতে পারত না? প্রশ্ন উঠছে।