একজন পুলকার চালক যেভাবে ‘হসপিটাল ম্যান’ হয়ে উঠলেন
২২ জানুয়ারি ২০২২সরকারি হাসপাতালের রোগীদের পাশে থাকতে হয় তাদের বাড়ির লোকেদের৷ দিনভর চিকিৎসা সংক্রান্ত দৌড়াদৌড়িতে সময় চলে গেলে তাদের আর খাওয়ার সময় মেলে না৷ তাছাড়া চিকিৎসা ব্যয়ে জর্জরিত পরিবারগুলির খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও অনেক সময় থাকে না৷ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে বিপুল জনসংখ্যায় রোগীর পরিবারকে খাবার জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেও করা হয়নি৷ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগীর খাবার থেকেই ভাগ নিচ্ছেন পরিবারের মানুষজন৷ এতে রোগীর পুষ্টির ঘাটতি হয়ে যায়৷
সমস্যাটা নিয়ে বিচলিত হয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট এলাকার বাসিন্দা পেশায় পুলকার চালক পার্থ কর চৌধুরী৷ তিনি পাঁচ বছর লাগাতার ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনটি সরকারি হাসপাতালের সামনে রোগীর পরিবারের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিয়েছেন বিনা পয়সায়৷ কোভিড পরিস্থিতিতে এ সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল৷ লকডাউনে খাবার দোকান বন্ধ৷ অসহায় মুখগুলির জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেন পার্থ৷ কোভিডের সময় সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে সেবা করতে গিয়ে কোভিড আক্রান্তও হয়েছিলেন তিনি৷ তবুও বিরতি নেই তার কাজে৷ হয়ে উঠেছেন শহর কলকাতার মানবিক মুখ ‘হসপিটাল ম্যান’৷
দক্ষিণ কলকাতার তিনটি বড় সরকারি হাসপাতাল, এসএসকেএম, শম্ভুনাথ পণ্ডিত আর চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের সামনে একাকী ৫২ বছর বয়সি পার্থকে খাবার বিলি করতে দেখা যাবে দিনের তিনটি সময়ে৷ ডয়চে ভেলেকে পার্থ বলেন, ‘‘২০১৬ সালে আমি নিজেই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম৷ রোগীর পরিবারের মানুষদের দেখেছি খুব কাছ থেকে৷ সরকারি হাসপাতালে আর্থিক অবস্থা তো বটেই, উপরন্তু দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়েও খাবার খাওয়া হয় না৷ তখনই আমি ওদের খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই৷’’
আমাদের রাজ্যে ইতিমধ্যে শ্রমজীবী ক্যান্টিনে ২০ টাকায় এবং মা ক্যান্টিনে পাঁচ টাকায় পেট ভরে ভাত খাওয়ার পরিষেবা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সবাই কি তাতে লাভবান হয়েছে? প্রশ্ন করেন পার্থ৷ তিনি মনে করেন, ‘‘রেকি করে দেখার প্রয়োজন আছে, কাদের প্রয়োজন যথার্থ৷’’ বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহ করেছেন পার্থ, কখনো নিজেই খাবার ব্যবস্থা করেছেন৷ পার্থ বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে রাত ১২ টা- ১টা বেজে গিয়েছে৷ তখনও দেখেছি অত রাতেও কিছু মানুষে খাবারের প্রত্যাশায় বসে আছেন৷’’ কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে যখন দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেল, তখন কলা, বিস্কুট, মুড়ির মতো শুকনো খাবার দেওয়া শুরু করলেন৷ এরপর মানুষই পার্থর পাশে এসে দাঁড়ান৷ চাল, ডাল পেতে শুরু করলেন৷ তা দিয়ে রান্না করে খাবার নিয়ে যেতে লাগলেন৷ এভাবেই বছরভর, রোজ প্রায় দেড়শ মানুষকে সেবা দিয়ে চলেছেন ‘হসপিটাল ম্যান’ পার্থ৷
জনস্বাস্থ্যের চিকিৎসক অলোক বিশ্বাস বলেন, ‘‘রোগীর পরিবার এই কষ্টটা একদিন নয়, মাসের পর মাস ধরে ভোগ করেন৷ আমি দেখেছি, লিভার বা হার্টের রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে তার পুরো পরিবারটাই ভেসে যায়৷ আমাদের দেশে এমন একটা সরকারি পরিষেবা থাকা উচিত ছিল, যেখানে সহজে রোগীর পরিবার খাবার পেতে পারেন৷'' অর্থাৎ যে ব্যবস্থা সরকারের করা উচিত ছিল, সেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ করে চলেছেন ‘হসপিটাল ম্যান’৷ তবে খুব সহজেই তিনি সরকারি হাসপাতালের রোগীর পরিবারের মুখে খাবার ধরতে পারছেন, এমনটা নয়৷
হাসপাতালের পাশে থাকা খাবারের দোকানগুলি পার্থর বিরোধিতা করেছে কখনো, কখনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সীমানা থেকে বের করে দিয়েছেন, কখনো পুলিশি হাঙ্গামা৷ এমনকি কোভিড পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যাতায়াত করতেন বলে পাড়া থেকেও তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছিল৷ কোনো কিছুতেই পিছু হঠেননি তিনি৷ একসময় স্কুলের পুলকার চালক পার্থ প্রথমদিকে স্কুলের দায়িত্ব পালন করে হাসপাতালে খাবার বিলি করেছেন৷ এরপর কোভিডে স্কুলের কাজ হারালেও তার সেবাকাজ থামে না৷ জমানো টাকার ভাণ্ডার থেকে খরচ করে খাবারের ব্যবস্থা করতেন৷ সেটা ফুরিয়ে গেলেও তিনি হাল ছাড়েননি৷ এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন৷ ঋণের টাকাতেই এখন গাড়ির তেল, রান্নার খরচ চালান৷ ক্রাউড ফান্ডিংয়ে বিশ্বাস তার নেই৷ মানুষ দিতে চাইলে তবেই তিনি নেন সাহায্য৷ ভবিষ্যতে হসপিটাল ম্যান সারাজীবন এইভাবে রোগীর পরিবারের মুখ খাবার তুলে দিতে কমিউনিটি কিচেন গড়ে তুলতে ইচ্ছুক৷
ইতিমধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে কিছু দুঃস্থ পরিবারকে রেশন তুলে দিয়েছেন, খুলেছেন বিনামূল্যে মেডিকেল পরিষেবার ব্যবস্থা৷ চিকিৎসক বিশ্বাস বলেন, ‘‘এইভাবে ব্যক্তিগতভাবে পার্থদার এগিয়ে আসা একটা বিরাট মহৎ কাজ৷ এমন কাজ আর কেউ করে না৷ পুরো একাকী যেভাবে তিনি কাজটা করেন, সেটা অতুলনীয়৷’’