1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লোকসংস্কৃতির চর্চা ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব

২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

আকাশ সংস্কৃতির কারণে লোকসংস্কৃতি থেকে আজ আমরা বিচ্ছিন্ন৷ কিন্তু নিজের শেকড়কে না জানলে কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব না৷ আমাদের শেকড় লুকিয়ে লোকগান, হস্তশিল্প ও সাহিত্যে৷ তাই এগুলোকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ৷

https://p.dw.com/p/2psJw
Bangladesch - Kultur - Stierkampf
ছবি: M. M. Rahman

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা তিনটি: নগরসংস্কৃতি, গ্রামসংস্কৃতি ও উপজাতীয় সংস্কৃতি৷ কিন্তু এ সব সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে আজ মুখ্য হয়ে উঠেছে আকাশ সংস্কৃতি৷ এই আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবেই আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি৷

ছোটবেলায় আমরা গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যেতাম৷ গাইবান্ধার নূরপুর গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি৷ প্রতিদিন দুপুরের খাওয়া শেষে দেখতাম শীতল পাটি বিছিয়ে বাড়ির মেয়ে-বউরা কাঁথা সেলাই করতে বসতেন৷ একজন গান ধরতেন, যেটাকে তাঁরা বলতেন গীত৷ এই গীত কিন্তু কোনো শেখা গান নয়, যার যা মনে আসতো তাই দিয়ে একজনের কাছ থেকে আর একজন কথা কেড়ে নিয়ে গান বাঁধতেন৷ এ এক অপূর্ব দৃশ্য৷

এছাড়া ঢেঁকিতে ধান বা জলপান ভাঙার সময়ও তাঁরা গীত গাইতেন৷ বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন বাড়ির বৃদ্ধারা গীত বানাতেন নতুন জামাই বা নতুন বউয়ের ‘বদনাম' করে৷ সেটা উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে আনন্দ দিতো৷ পাশাপাশি এই যে সুখ স্মৃতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা এটা আমার কাছে একটা সম্পদের মতো৷ এই যে সংস্কৃতি এটা কিন্তু চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে৷

আরও একটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করতেই হয়৷ সেটা হলো দুর্গা পূজার সময় এই ছোট্ট গ্রামটিতে যাত্রাপালা হতো পুরো পাঁচ দিনব্যাপী৷ এই যাত্রার শিল্পীদের ঐ গ্রামের বাইরে থেকে আনা হলেও স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরাও কিন্তু অংশ নিতেন এতে৷

গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই কিন্তু তালপাখা বানাতে জানতেন৷ প্রচণ্ড গরমে শিতলপাটি আর তালপাখার হাওয়ার শীতল পরশ বুলিয়ে দিত শরীরে৷ আর একটি বিষয় ছিল পুঁথি পড়া৷ সোনাভানের পুঁথি – কী অসাধারণ লাগত গানের সুরে পুঁথি পড়া৷ শহুরে শিশুদের কথা দূরে থাক, গ্রামের শিশুরাও কিন্তু এ সব সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত৷ কারণ প্রত্যন্ত গ্রামেও ঢুকে পড়েছে বোকা বাক্স৷ আর তাতেই বন্দি তাদের শৈশব৷ এরা জানে না পুঁথি কী, যাত্রা কী, প্রবাদ-প্রবচন কী, লোকগান কী৷ তবে এটা তাদের ব্যর্থতা নয়৷ ব্যর্থতা আমাদের, এই রাষ্ট্রের৷ কারণ আমরা আমাদের লোকসংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার কোনো চেষ্টাই করিনি৷

এখন বিভিন্ন স্কুলে যেসব প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি – এ সব গানের কোনো প্রতিযোগিতা হয় না৷ হয় না কোনো গম্ভীরা৷ যাত্রাপালার নামে বসে মাদকের আড্ডা৷ ভাটি অঞ্চলের মানুষ তাঁদের গানের মাধ্যমে কী কথা বলতে চাইছেন সেটা যখন গানের মাধ্যমে শেখা হয়, তখন সেই অঞ্চলের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়৷

বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে৷ দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি জাতির প্রকৃত পরিচয় বহন করে৷

আমাদের হস্তশিল্প আজ বিদেশে ভীষণ চাহিদা৷ কিন্তু নিজের দেশে এর চাহিদা আছে কি? আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় দেখেছি পাটের দড়ি দিয়ে বানানো শিকায় মাটির ভাড়ে রসুন, শুকনো মরিচ এ সব রাখা হতো৷ অথবা শিকায় গাছ ঝোলানো হতো৷ এখন শিকা কয়জনের বাসায় দেখতে পাওয়া যায়?

হস্তশিল্পের জায়গা দখল করেছে সস্তার প্লাস্টিকের দ্রব্য৷ মোড়া বা বেতের চেয়ারের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের চেয়ার৷ শীতল পাটিরও বিকল্প বের হয়েছে৷

গরমের সময় মাটির কুঁজোর পানি যে কী ঠান্ডা লাগতো! রেফ্রিজেটরের কারণে এখন তো এটা কেউ ব্যবহারই করে না৷ আমাদের এলাকায় প্রতি বৃহস্পতিবার হাটে কুমোরেরা মাটির জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসত৷ দু'বছর আগে সেই হাটে গিয়েছিলাম একটা কুঁজো কিনবো বলে৷ কিন্তু খুঁজেই পেলাম না৷ কেবল মাটির টব আর খুঁটি নাটি কয়েকটা জিনিস৷ আগে বিশাল জায়গা জুড়ে যে পসরা বসত৷ আজ তা দু-তিনটি দোকানে সীমাবদ্ধ৷

পটুয়া কামরুল হাসান আমাদের সরা শিল্পকে বিখ্যাত করে তুলেছেন৷ আগে পূজামণ্ডপে এই মাটির সরাতেই প্রাদ বিতরণ করা হত৷ আজ হয় প্লাস্টিকের ব্যাগে৷

আমাদের লোকগান সংগ্রহ করা হচ্ছে কি? না কিছু ব্যান্ডের বদৌলতে অল্প কয়েকটি গান হয়ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ কিন্তু আমাদের লোকগানের যে বিশাল ভাণ্ডার তা সংরক্ষণ করা তো হচ্ছে না৷ তার চর্চাও হচ্ছে না৷

আমাদের যে হস্তশিল্প তাতে কিন্তু মানুষের কথাই বলা হয়েছে , বলা হয়েছে গ্রাম বাংলার কথা৷ এ দেশে লোক সংস্কৃতির ধারা প্রায় অচল হতে বসেছে আমাদেরই কারণে, আমাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে৷ আমরা আমাদের লোকসংস্কৃতিকে হাতে ধরে নষ্ট করছি৷

পরনির্ভর মানসিকতার কারণে আমরা নিজেদের দিকে তাকাই না, নিজের সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকেও তাকাই না৷ এমনিভাবে লোকসংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করি না, লোকসংস্কৃতিকে জীবনের আহ্বানে সম্পর্কিত করি না৷

লোককাঁথা চকচকে ঘরে শোভা পায়, ড্রইংরুমে শোভা পায়, লোকশিল্পের হস্ত নির্মিত বিভিন্ন সামগ্রী ড্রইংরুমে প্রদর্শিত হয়, এর বৈচিত্র্যময় আবেদনের কারণে৷ এছাড়া লোকসংস্কৃতির সামগ্রীসমূহ বিদেশে রপ্তানি করে অনেকে টাকা-পয়সা রোজগারে সফলও হচ্ছেন৷ এভাবে একদিকে লোকসংস্কৃতির ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে৷ কিন্তু দেশের মধ্যে দেশের মানুষের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যে টেনে আনি না৷ এ জন্য সচল ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন৷ এ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে আপন সংস্কৃতির প্রতি টান থেকে, মান থেকে; গড়ে উঠতে পারে জীবনকে নিজস্ব ঐতিহ্যে রূপময় করে বিকশিত করার ইচ্ছে থেকে৷ এ জন্য জাগরণ প্রয়োজন বিভিন্ন স্তরে৷

অনেক লোককাহিনি এখনো গ্রামবাংলায় টিকে আছে৷ সেইসব লোককাহিনি গ্রন্থে গ্রন্থে প্রকাশিত হতে পারে৷ এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিসহ উৎসাহী প্রকাশক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন৷ লোককাহিনি, ছড়া, প্রবচন ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ আমাদের লোক সংস্কৃতির ভাণ্ডার৷ অথচ সেগুলো সংগ্রহ বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হস্তশিল্পগুলো যেমন বেতশিল্প, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, চামড়াশিল্প, বুননশিল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ কিন্তু হস্তশিল্পের সঙ্গে যেসব পেশাজীবী জড়িয়ে আছেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে শোষিত৷ তাঁরা পণ্যের সঠিক মূল্য পান না৷ তাই এ সব পেশায় টিকে থাকা তাঁদের জন্য বেশ কষ্টকর৷ এ বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা দরকার৷ এদের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি, না হলে হস্তশিল্পের সম্ভাবনা যেটুকু আছে তাও হারিয়ে যাবে৷

অমৃতা পারভেজ
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

লোকসংস্কৃতির আর এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐশ্বর্য গ্রামীণ খেলাধুলা৷ বহু যুগ ধরে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গ্রাম বাংলায় নানা ধরনের খেলাধুলার প্রচলন রয়েছে৷ কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে৷

অবহেলায় অবহেলায় লোকসংস্কৃতির সহজ সরল ধারা আজ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে উপনীত হচ্ছে৷ এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রও৷ রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম – সংস্কৃতির ধারাকে বেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সে কারণে এ সবের ওপর সংস্কৃতির বিকাশও নির্ভরশীল৷

মোদ্দা কথা হলো, নিজের সংস্কৃতিকে যদি না জানি, যদি চর্চা না করি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না৷ আর জাতির উন্নয়ন না হলে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন কীভাবে হবে?

এ বিষয়ে আপনার কিছু বলঅর থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অমৃতা পারভেজ৷
অমৃতা পারভেজ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য