লীগের 'অঙ্গে' কত 'রূপ'!
৩০ জুলাই ২০২১দুধ জুটলে দুধের মাছিরও অভাব হয় না। ফলে ক্ষমতার বাড়বাড়ন্তই যে এত 'ভুঁইফোঁড়' লীগ গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ঘটনাটা সম্ভবত বছর পাঁচেক আগের। বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলে কর্মরত থাকার সূত্রে একটি আয়োজন নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। এখন কী অবস্থা জানি না। কিন্তু তখন সপ্তাহে প্রায় সাত দিনই প্রেসক্লাবের সামনে একাধিক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হতো। বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ না হলে সেজন্য আলাদা করে এসব মানববন্ধন সংবাদের জন্যও তেমন গুরুত্ব বহন করতো না, তেমন একটা নজরও কাড়তো না।
সেসময় শিক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে বেশ আলোচনা চলছিলো। ফলে প্রেসক্লাবের ভেতর থেকেই বাইরে মাইকে 'নাস্তিক্যবাদি', 'হিন্দুয়ানি', 'কুফরি' ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ শুনে বেশ আগ্রহ জাগ্রত হয়। সাধারণত সরকারের নীতির বাইরে গিয়ে এমন বিষয়ে গরম গরম কথা বলার জন্য প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপি বা তাদের সমমনা দলগুলোকে তেমন সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে কারা এমন সব কথা বলছে তা দেখতে মন চাইলো।
বাইরে গিয়ে ব্যানারে চোখ পড়তেই বুঝলাম, এ তো সেই 'আওয়ামী ওলামা লীগ'। এই রহস্যময় 'ওলামা লীগ' নিজেদের আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অনুসারী বলে দাবি করে, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন বলে মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
এর আগেও ওলামা লীগ বাংলা নববর্ষকে 'ইসলামবিরোধী' বলে আখ্যা দিয়ে এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার দাবি তুলে আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু নামের মধ্যে 'লীগ' থাকলেও শিক্ষা নিয়ে এই সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার প্রায় অনুরূপ ছিল। কিন্তু তারপরও তথাকথিত 'সেক্যুলার' একটি দলের সঙ্গে এমন 'কট্টরপন্থি' সংগঠনের সংযোগ থাকে কোন ভিত্তিতে?
আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বিতর্ক সৃষ্টি হলেই নিজেদের ওলামা লীগ থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। 'ওলামা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই', এমন মন্তব্য একাধিক শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাই গণমাধ্যমদের সামনে করেছেন। ‘সম্পর্ক' না থাকা সত্ত্বেও এসব ছবি ও নামসর্বস্ব সংগঠনগুলো কোনো ধরনের আইনী জটিলতা ছাড়াই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে ও যাচ্ছে৷
বারবারই দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে ‘নাম ভাঙিয়ে খাওয়া'র বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি আমরা শুনেছি৷ কিন্তু এজন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা চোখে পড়েনি৷ সম্প্রতি দেশ রূপান্তর পত্রিকা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘‘ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর বিষয়ে আমরা কঠোর। ইতিমধ্যে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যারা আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে অপকর্ম করে আসছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রমাণ মিললেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।''
যেখানে বিভিন্ন নামসর্বস্ব সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেরাই ভিজিটিং কার্ড, ফেসবুক, পোস্টার ইত্যাদি নানা মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার চালিয়ে আসছেন, সেখানে ‘প্রমাণ মিললে আইনের আওতায় আনা হবে' বক্তব্যটি অবশ্য ঠিক বোধগম্য না৷
ব্যবস্থা নিতে এমন গরিমসির দুটো কারণ থাকতে পারে৷ অনুমোদিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে অনেক নেতাকর্মীকে কমিটিতে রাখা যায় না৷ ফলে দীর্ঘদিন ধরে পদ পাওয়ার আশায় কাজ করে যাওয়া নেতাকর্মীকে এইসব অনুমোদনহীন সংগঠনের সুবাদে একটা ‘সান্ত্বনা পুরস্কার' দেয়া যায়৷ ফলে মাঠে শক্তিপ্রদর্শনে আরো বেশি এগিয়ে থাকা যায়৷ অন্যদিকে, সেসব সংগঠনের অপকর্মের দায়ও নিজেদের ঘাড়ে নিতে হয় না৷ ‘অনুমোদনহীন সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে' বিবৃতি দিয়েই পার পাওয়া যায়৷
পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে ১০৫টি ভুঁইফোড় সংগঠনের সন্ধান পেয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্যও নাকি রয়েছে পুলিশের কাছে৷ এইসব ‘লীগের' কয়েকটি হচ্ছে- বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ, নাপিত লীগ, দর্জি লীগ, ফকির লীগ, হারবাল লীগ, ডিজিটাল লীগ, পর্যটন লীগ, সমবায় লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, স্বাধীনতা লীগ, প্রবীণ লীগ, আওয়ামী অভিভাবক লীগ, নাগরিক লীগ, তরুণ লীগ, তৃণমূল লীগ, জননেত্রী লীগ, তরিকত লীগ ইত্যাদি৷
‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ' নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হওয়ায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটি থেকে তড়িৎ অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তাকে অন্য ‘নানা কারণ’ দেখিয়ে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ কিন্তু এই আলোচনাটা একবার সামাল দিয়ে দিলে বাকিদের কি আদৌ কিছু হবে? অতীত অভিজ্ঞতা কী বলে?