আওয়ামী লীগের নামে শত ‘লীগ’
২২ জানুয়ারি ২০১৯আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী ওলামা লীগের কোনো সম্পর্ক নেই– এ কথা বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে সোমবার৷ ওই দিনই ওলামা লীগ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক মানববন্ধনে যেসব এনজিও বাল্য বিয়ে বন্ধের জন্য কাজ করছে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়৷ একইসঙ্গে বিপিএলের নামে জুয়া খেলা হচ্ছে দাবি করে বিপিএল বন্ধেরও দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা৷ এই খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাতক আব্দুস সোবহান গোলাপ দলের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে জানান, ‘‘আওয়ামী ওলামা লীগ নামে আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠন নেই৷ আওয়ামী লীগের নামে তাদের যে-কোনো ধরনের কার্যক্রম অবৈধ এবং বেআইনি৷'' আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে ওলামা লীগের নামে যারা তৎপরতা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানানো হয় ওই বিবৃতিতে৷
কিন্তু আওয়ামী লীগের এই অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি মাওলানা আখতার হোসাইন বোখারী৷ তিনি নিজেকে ‘টাঙ্গাইলের পীর' দাবি করে বলেন, ‘‘২০০১ সাল থেকে আমরা আওয়ামী লীগের সাথে আছি৷ আমরা মঠে আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম৷ এখন যদি কেউ বলে আমরা আওয়ামী লীগের কেউ না, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আমাকে এই সংগঠনের সভাপতি করেছেন৷ আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ নাসিম, হাছান মাহমুদসহ বড় বড় নেতাদের সঙ্গে আমাদের ছবি আছে৷ আমার কাছে অনেক প্রমাণ ও ডকুমেন্ট আছে অফিসে এসে দেখে যান৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, শেখ হাসিনাকে ভালোবাসি৷ তিনি আমার চিকিৎসার জন্য অনুদানও দিয়েছেন৷ এখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছ থেকে জানবো তিনি আমাদের ব্যাপারে কী বলেন৷ তিনি যা বলেন, আমরা তা মেনে নেবো৷ আর কে কী বললো তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না৷''
বাল্য বিবাহের পক্ষে অবস্থানের ‘যুক্তি' দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকার বিয়ে হয় ৯ বছর বয়সে৷ তাই বাল্য বিবাহ ইসলাম সমর্থন করে৷ এর বিরুদ্ধে যাওয়া ইসলামের বিরোধিতা৷ এটাই আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর চেষ্টা করেছি৷ এখন বাকিটা তাঁর সিদ্ধান্ত৷ আর বিপিএলের নামে জুয়া খেলা হয়, এটা সবাই জানে৷ কয়েকজনকে পুলিশ ধরেছেও৷ বঙ্গবন্ধু জুয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ তাঁর রাষ্ট্রে কিভাবে জুয়া চলে৷ আমরা বিপিএল ক্রিকেট খেলা বন্ধ নয়, জুয়া বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি৷''
২০১৬ সালেও আরেকবার আলোচনায় এসেছিল আওয়ামী ওলামা লীগ৷ তখন তাঁরা বলেছিল,‘পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, উলুধ্বনি দেওয়া, শাঁখ বাজানো, মঙ্গল কলস সাজানো, ঢাক-ঢোলের ব্যবহার, মুখোশ পরে শোভাযাত্রা, মুসলিম মহিলাদের সিঁথিতে সিঁদুর দেয়া বিধর্মীদের কাজ৷ মুসলমানদের ইসলামহীন করার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে৷ তাই এ অপতৎপরতা বন্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে নববর্ষ উদযাপন বন্ধ করতে হবে৷''
তখনো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, আওয়ামী ওলামা লীগ বলে আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন নেই৷ কিন্তু সেই কথা আমলে না নিয়ে আওয়ামী ওলামা লীগ তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে৷ প্রতিক্রিয়ায় তারা তখন বলেছিল, ‘‘যারা বলে ওলামা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই তারা ভূঁইফোড়৷'' এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷
আওয়ামী লীগের যত সহযোগী সংগঠন
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাতটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে আওয়ামী লীগের৷ এর বাইরে দুটি সংগঠন শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত৷ সহযোগী সাতটি সংগঠন হলো: মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইন পরিষদ৷
আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'-এর অনুমোদন নিতে হয়৷ তবে তার নীতিমালা কী তা জানা যায়নি৷
এরা কারা?
তবে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এর বাইরে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার নাম ব্যবহারসহ নানা কৌশলে শতাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে৷ যেমন: বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎসজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদশে আওয়ামী পর্যটন লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, আমরা নৌকার প্রজন্ম, আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, তৃণমূল লীগ, আমরা মুজিব হবো, চেতনায় মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা তরুন লীগ, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎসজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম প্রভৃতি৷
‘আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমরা এর আগেও বলেছি আওয়ামী ওলামা লীগ নামে আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠন নেই৷ আবারো বলছি, তারা আওয়ামী লীগের কেউ নয়৷ তারা আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে কিছু করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে৷''
তাঁরা তো বলছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, শেখ হাসিনা তাঁদের ওলামা লীগ করতে বলেছেন– এই বিষয়টি জানানোর পর তিনি বলেন, ‘‘তারা আওয়মী লীগ করুক৷ অনুমোদন না দিলে আওয়ামী লীগের নামে কোনো সংগঠন করা যাবে না৷''
আরো যে শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন আছে তাদের ব্যাপারে কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করেছি৷ আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, আমাদের সহযোগী এবং ভাতৃপ্রতীম সংগঠন অনুমোদিত আছে৷ এর বাইরে যারা আছে, তারা আওয়ামী লীগের কেউ না৷ কেউ যদি আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অনুমোদ ছাড়া, তারা বেআইনি কাজ করছে৷''
আইনগত ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেউ যদি কোনো সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করে এবং আমরা যদি অভিযোগ পাই তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো৷ আর আমরা আমাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেও ব্যবস্থা নিতে পারি৷''