রোগীর তুলনায় ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অনেক কম
২৮ আগস্ট ২০১৮ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ক্যানসারের রোগী বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ কারণ কী?
ডা. মশিউর রহমান : প্রকৃতপক্ষে এর কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ- সুবিধা বেড়েছে৷ মানুষের মধ্যে রোগ সচেতনতাও বেড়েছে৷ এ কারণে তাঁরা হাসপাতালে ও চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন৷ তাই মনে হচ্ছে রোগী বেড়ে গেছে৷ আমরা প্রবীণ ডাক্তারদের কাছ থেকে শুনেছি, এই রোগটা অনেকদিন ধরেই বেশি৷ আগে এত বেশি সচেতনতা ছিল না, তাই মানুষ এ রোগটি সম্পর্কে ভালো জানতেন না৷ আগে কবিরাজি, আয়ুর্বেদি, ইউনানি চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষ এ রোগ সারানোর চেষ্টা করতেন৷ এ কারণে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যাটা ধারণা করা যেত না৷
বাংলাদেশে এখন ক্যানসারের চিকিৎসা কতটা উন্নত হয়েছে?
বাংলাদেশে বেশ কিছু চিকিৎসা কেন্দ্রে ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে৷ এ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে আধুনিক সরঞ্জামাদি রয়েছে৷ তবে এখনো কিছু টেকনিক্যাল অসুবিধা রয়ে গছে৷ এটা সত্য যে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক এ বিষয়ে যে পরিমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র থাকার কথা, তা আমাদের নেই৷ তবে কিছু বেসরকারি হাসপাতালসহ দু-একটা সরকারি হাসপাতালে আমরা বিশ্বমানের চিকিৎসা দিচ্ছি৷
আমরা দেখি, ক্যানসার ধরা পড়লেই অনেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন৷ দেশের চিকিৎসায় তাঁরা আস্থা পাচ্ছেন না কেন?
যে কোনো রোগেই মানুষ চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্ হওয়ার নিশ্চয়তা চান৷ এটা খুব স্বাভাবিক৷ কিন্তু আমাদের দেশে রোগীরা অনেক দেরি করে আমাদের কাছে আসেন৷ এটা অসচেতনতার কারণেও হতে পারে৷ তখন আমাদের পক্ষে রোগী সুস্থ্ হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব হয় না৷ তখন তাঁরা মনে করেন যে, দেশের বাইরে হয়ত সুস্থ হওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে৷ আবার এর কিছু অর্থনৈতিক কারণও আছে, যে কারণে অনেকেই ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন৷ আমাদের এখানে হাসপাতালে সিট সংখ্যাও সীমিত, এটিও হয়ত একটি কারণ৷
আমাদের দেশে অনেক সময় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় ভুল তথ্য আসে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্যানসারের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় নির্ভুলভাবে হচ্ছে?
এটা ৮০ থেকে ৯০ ভাগই নির্ভুলভাবে হচ্ছে৷ তবে আরো বেশি নির্ভুল হওয়ার জন্য আমাদের ডিসিপ্লিনড অ্যাপ্রোচ যাকে বলি, অনকোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, রেডিয়োলোজিস্ট সকলের সমন্বয়ে এটা হওয়া উচিত৷ এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আমাদের রয়েছে৷ তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল তথ্য চলে আসছে৷
ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে দেশে কতটা গবেষণা হচ্ছে?
এই একটা ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছি৷ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালে অনেকেই কাজ করে চলেছেন৷ বাইরেও বিভিন্ন সেন্টারে কাজ হচ্ছে৷ অনেকে পার্সোনালি এটা করছেন, তবে আমরা সমন্বিতভাবে এই কাজটা করতে পারিনি৷ এর নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে৷
ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার কি সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকতে পারে?
সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এখনই সেটা বলতে পারব না৷ কিছু কিছু ফ্যাক্টর মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি, কিন্তু সেটার রেজাল্ট বলবার মতো সময় এখনো আসেনি৷
বলা হয়ে থাকে, ক্যানসার পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব নয়, এটা কি ঠিক?
আসলে এটাকে কয়েকটা স্টেজে ভাগ করে চিকিৎসা দিতে হয়৷ কারো যদি প্রথম স্টেজে ধরা পড়ে, তাহলে এটা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব৷ আবার কারো যদি অ্যাডভান্স স্টেজ, অর্থাৎ স্টেজ-৪-এ ধরা পড়ে, তাহলে সেটা ছড়িয়ে যায় এবং এটা নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই সেটা সম্ভব না৷ বাইরে আরো নানা ধরনের টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধার কারণে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়৷
বাংলাদেশে ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা কত?
এই মুহুর্তে দেশে ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ১৩৫ জনের কাছাকাছি৷
রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কতটা কম?
এটা বেশ কম৷ একটা উদাহরণ বলি, হু'র সুপারিশ হলো, প্রতি এক মিলিয়ন মানুষের জন্য একটা ক্যানসার সেন্টার থাকতে হবে৷ সেক্ষেত্রে আমাদের ১৬০ মিলিয়ন জনগণের জন্য ১৬০টা ক্যানসার সেন্টার থাকা দরকার, যার প্রতিটিতে দু'টি করে মেশিন এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দরকার৷ প্রতিটি মেশিনের জন্য প্রতিটি সেন্টারে ৮ থেকে ১০ জন বিশেষজ্ঞ দরকার৷ সেক্ষেত্রে আমরা ১০ থেকে ১৪টি সেন্টারের জন্য বিশেষজ্ঞ দিতে পারছি৷ সরকারের সদিচ্ছা আছে৷ বিভিন্ন পোস্ট গ্রাজুয়েশন চালু হয়েছে৷ বিশেষজ্ঞ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমরা যাতে মিনিমাম একটা চিকিৎসা দিতে পারি, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে৷
বর্তমানে দেশে ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা কত? এমন কোনো তথ্য আছে?
সর্বশেষ ২০১২ সালের একটা হিসাব আছে, সেখানে আমরা প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ ক্যানসারের রোগী পাই৷ এটা হাসপাতালের রেজিস্ট্রি অনুযায়ী৷ এর মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারি৷ ২০০ রোগী বিদেশে চলে যাচ্ছেন৷ তাঁরা এখানকার হাসপাতালে যাচ্ছেন না৷ এই মুহুর্তে জনসংখ্যার হিসেবে আমাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই, যা আছে তা হাসপাতালের তথ্য৷ তা-ও আবার সব হাসপাতালের তথ্য একজায়গায় করা নেই৷ সেটা করতেও বছরখানেক লেগে যাবে৷ তখন হয়ত আমরা একটা ফিগার দিতে পারব৷
ক্যানসার চিকিৎসার মূল ওষুধগুলো কি বাংলাদেশে পাওয়া যায়?
এখন প্রধান ওষুধগুলো দেশেই তৈরি হচ্ছে৷ এ কারণে দামও অনেক কমে গেছে৷ আর আমাদের ক্যানসার গবেষণা ইনষ্টিটিউটে অর্ধেক রোগী ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছে৷
এখানে উৎপাদিত ওষুধ কতটা মানসম্পন্ন?
এটা আসলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেখে৷ আমরা যে ওষুধগুলো দেখি, সেগুলো লো স্ট্যান্ডার্ড, তা বলতে পারব না৷ আমাদের কাজ চলে যাওয়ার মতো একটা স্ট্যান্ডার্ড এখানে মেনটেইন করা হচ্ছে৷
যাদের ক্যানসার ধরা পড়েছে, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী হবে?
আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ ক্যানসারের কিছু প্রিভেনটিভ জায়গা রয়েছে৷ এটা নিয়ে মোটিভেশনাল প্রচার থাকা উচিত৷ যদি প্রিভেনটিভ মেজার না নেয়া যায়, তাহলে ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে৷ সঠিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক স্টেজে ধরা পড়লে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ রোগী ভালো হয়ে যায়৷ যত দেরি করবেন, তত জটিল আকার ধারণ করবে৷ শেষ পর্যন্তও এই রোগের চিকিৎসা আছে৷
অনেক রোগীই তো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পারেন না...
সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব আছে৷ সরকারও সম্মতি দিয়েছে৷ সেটা হলো, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটা করে ক্যানসার সেন্টার করা হবে৷ তখন রোগীদের কষ্ট করে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ঢাকায় আসতে হবে না৷ এখানে আসলে থাকা-খাওয়াও কঠিন৷ সেক্ষেত্রে তাঁরা কাছের সেন্টারগুলোতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবেন৷ এই সেন্টারগুলো চালাতে যে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, সেটাও এই প্রজেক্ট চলাকালে তৈরি হয়ে যাবে৷