বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় সংকট কোথায়?
২৭ আগস্ট ২০১৮আহমেদ গোলাম আরিফ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন৷ গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পাকস্থলির ক্যানসার ধরা পড়ে৷ এরপর তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন মোটামুটি সুস্থ৷ তাঁর এই ক্যানসার চিকিৎসায় ১৬ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি তাঁর চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান৷ জানান, খরচ সম্পর্কেও৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার শুধু অপারেশনেই খরচ হয়েছে ছয় লাখ টাকা৷ আর অপারেশন পর্যন্ত বিভিন্ন টেস্টে খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা৷ এরপর আমাকে ৬ সাইকেল কেমোথেরাপি নিতে হয়৷ ২১ দিন পরপর৷ প্রতি সাইকেল কেমোথেরাপির জন্য ওষুধসহ খরচ পড়েছে এক লাখ টাকা৷ আর আমাকে কেমো শুরুর আগে পিইটি স্ক্যান নামে একটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা করাতে হয়েছে, যা বাংলাদেশের মাত্র তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে হয়৷ ওই স্ক্যানে খরচ পড়েছে এক লাখ টাকা৷ এখনো আমার পুরো চিকিৎসা শেষ হয়নি৷ আবারো পিইটি স্ক্যান করতে হবে৷''
তিনি জানান, ‘‘অন্যান্য হাসপাতালে এই ধরনের ক্যানসার চিকিৎসার খরচ আরো বেশি৷''
ঢাকার হোসনে আরা বিনু তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা করিয়েছেন ভারতের মুম্বাইয়ে৷ বাংলাদেশে চিকিৎসা না করিয়ে কেন ভারতে করালেন– জানতে চাইলে বলেন, ‘‘২০০৪ সালে আমার ব্রেস্টে একটা টিউমারের মতো দেখা দিলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন করাই৷ এরপর বায়োপসি করানোর পর বলা হয়, আমার কোনো ক্যানসার হয়নি৷ কিন্তু দুই বছর পর আবার গোটার মতো হলে পরীক্ষায় ক্যানসার ধরা পড়ে৷ এরপর আর বাংলাদেশে চিকিৎসা করাতে সাহস পাইনি, কারণ, ক্যানসার থাকার পরও আমাকে প্রথমবার বলা হয়েছে ক্যানসার নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘২০০৭ সালে মুম্বাইয়ে আমি শুধু অপারেশন করিয়েছি৷ দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে৷ ঢাকায় কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপি নিয়েছি৷ ছয় সাইকেল কেমো থেরাপির প্রতি সাইকেলে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টকা করে৷ আর ৩১দিন রেডিও থেরাপিতে প্রতিদিন খরচ হয়েছে এক হাজার ৯শ' টাকা করে৷''
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি)-র তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন৷ মারা যায় ৯১ হাজার৷ জাতীয় ক্যানসার ইন্সটিটিউটের ক্যানসার এপিডেমিওলোজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এক জরিপে দেখেছি, হাসপাতালগুলোতে আসে মাত্র ৪৫ হাজার রোগী৷ এর মানে হলো, কোনো কোনো রোগী দেশের বাইরে যায়৷ আবার কেউ কেউ স্থানীয় বিকল্প চিকিৎসা বা টোটকা চিকিৎসা করায়৷''
বংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইন্সটিটিউট৷ এর বাইরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতালসহ বিভাগীয় পর্যায়ের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে আলাদা ক্যানসার বিভাগ আছে৷ আর জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার ইউনিট আছে৷ ঢাকার বাইরে ৩০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে ১৪টিতে ক্যানসার বিভাগ আছে৷ দেশে সরকারি পর্যায়ে এই হাপাতালগুলো মাত্র ২০টি কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার সেন্টার আছে৷ বেসরকরি পর্যায়েও ক্যানসার চিকিৎসা আছে৷ তবে তার খরচ অনেক বেশি৷ বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা ১২০ জন৷
ক্যানসার রোগ নির্ণয়ের পর তিন ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়৷ সার্জারি, কোমোথেরাপি এবং রেডিওথেপারি বা বিকিরণ চিকিৎসা৷ আরো কিছু আধুনিক চিকিৎসা আছে৷তারপরও কেন দেশে ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি আস্থা প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না তার কারণ জানাতে গিয়ে ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘‘ক্যানসার চিকিৎসা এবং রোগ নির্ণয়ে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে আছে৷ পিইটি স্ক্যানের যন্ত্রও সরকারি হাপাতালে যুক্ত হয়েছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দক্ষ লোকবলের৷ যন্ত্র থাকলেইতো হবে না, তা চলানোর লোক লাগবে৷'' তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘যেখানেই একটি রেডিওথেরাপি মেশিন থাকবে, সেখানেই এটা পরিচালনার জন্য পুরো একটি বিভাগ লাগবে৷ কিন্তু তা নেই৷ যারা এসব মেশিনপত্র সাপ্লাই দেয়, তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে সেবা দেয় কিছু দিন৷ অনেক সরকারি হাসপাতালে এই মেশিন থাকলেও চালানোর লোক নেই৷''
বাংলাদেশে সরকারি ইন্সটিউটে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কম৷ সেখানে অনেক ক্ষেত্রে সার্জারিতে কোনো খরচ লাগে না৷ কেমোথেরাপিতে ৪-৫ হাজার টাকা রেডিওথেরাপিতে মোট ১৫-২০ হাজার টাকা৷ কিন্তু এই সুযোগ খুব সামান্য সংখ্যক রোগীই পান, কারণ, এখানে অবকাঠামোগত সুবিধা খুবই অপ্রতুল৷ বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি সাইকেল কেমোথেরাপিতে গড়ে ৩০ হাজার টাকা নেয়া হয়৷ রেডিওথেরাপিতে নেয়া হয় গড়ে দেড় লাখ টাকা আর সার্জারিতে তিন থেকে ছয় লাখ টাকা৷ এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরো পরীক্ষার খরচ আছে৷ বেড ভাড়ায় অনেক টাকা চলে যায়৷''
সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল এবং অবকাঠামো না থাকায় রোগীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় আর তা করতে গিয়ে রোগী অনেক সময় সার্জারির বাইরে চলে যান৷ রোগীদের অপারেশনের জন্য এক মাস, কেমোথেরাপির জন্য ২-৩ সপ্তাহ আর বিকিরণ চিকিৎসার জন্য অনেককে ৪ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়৷
দেশের মাত্র ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু আছে৷কিন্তু রেডিওথেরাপি মেশিন আছে মাত্র ৯টিতে৷ ৬০ ভাগেরও বেশি ক্যানসার রোগীর রেডিও থেরাপির প্রয়োজন হয়৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলোজি বিভাগের সাবেক প্রধান ও ক্যানসার সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ১৬০টি রেডিওথেরাপি সেন্টারের প্রয়োজন৷ আছে মোটে ২০-২২টি৷ এখন বেসরকারি পর্যায়ে যেগুলো আছে, তারা তো অনেক টাকা নেয়৷ কারণ, সেখানে তো আর সরকারি সাবসিডি নেই৷ তাই সরকারি পর্যায়ে এটা বাড়ানো দরকার, যাতে গরিব রোগীরা কম খরচে চিকিৎসা পায়৷ একইভাবে ক্যানসারের অন্যান্য চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালের অংশগ্রহণ না বাড়লে গরিব রোগীরা চিকিৎসা পাবেন না৷''
তিনি জানান, সরকার এক হাজার বেডের একটি কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার হাসপতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে৷ তিনি মনে করেন, সেটা হলে চিকিৎসা সংকট কিছুটা দূর হবে৷
বাংলাদেশের ক্যানসার চিকিৎসার একটা ভালো অগ্রগতি হয়েছে ওষুধের ক্ষেত্রে৷ বাংলাদেশেই এখন ৭০-৭৫ ভাগ এন্টি ক্যানসার ড্রাগ তৈরি হচ্ছে৷ ফলে রোগিদের ওষুধের খরচ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে৷ ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘‘আমরা দেশে তৈরি ক্যানসারের যেসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করি, তাতে রোগীরা ভালো ফল পাচ্ছেন৷ আমাদের দেশেই এখন ক্যানসারের দুই তৃতীয়াংশ ওষূধ তৈরি হচ্ছে৷ এটা একটা নীরব বিপ্লব৷ আমরা আমাদের দেশে তৈরি ক্যানসারের ওষুধের মান নিয়ে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই৷ কিন্তু সেই সুযোগ নেই৷ সুযোগটি থাকলে আমরা মান সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হতে পারতাম৷''
ডয়চে ভেলেকে দু'জন চিকিৎসকই জানান, প্রায় সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসাই এখন বাংলাদেশে হয়৷ তবে তাঁরা স্বীকার করেছেন যে রোগীদের মাঝে এখনো আস্থার সংকট আছে এবং তা দূর করতে সময় লাগবে, কেননা, ক্যানসার চিকিৎসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে অবকাঠামো৷ তাঁদের মতে, সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট উদার৷ কিন্তু তাঁরা মনে করেন, সরকারের ব্যাপক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে চিকিৎসা খরচ হাতের নাগালের মধ্যে আনা খুব জরুরি৷