মুমূর্ষুরে দিও না উড়ায়ে
১৪ এপ্রিল ২০২০গানটির দ্বিতীয় বাক্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে', ‘মুমূর্ষুরে' ‘উড়ায়ে' দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ অর্থাৎ, নির্মল বিশুদ্ধ বাতাস যাতে সকল রোগ-শোক উড়িয়ে নিয়ে যায়৷ গানের এই অংশে আসতেই আমার চোখ পড়লো ঠিক বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি দর্জির দোকানে৷ জার্মানির অন্য সব দোকানের মতো এই দর্জির দোকানটিও বন্ধ৷ কিন্তু জানালায় বড় করে মাস্কের ছবি টানানো৷ নোটিশে লেখা রয়েছে ফোনে অর্ডার দিলে তারা হাতে মাস্ক তৈরি করে দিবেন৷
জার্মানির কোনো শহরেই এখন মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না৷ ফার্মেসিগুলোতে প্রতিদিন এতো মানুষ মাস্ক খুঁজতে আসেন যে বিরক্ত হয়ে অনেক ফার্মেসির দরজাতেই ‘মুখোশ নেই' নোটিশও টানিয়ে রেখেছেন৷ হাসপাতালগুলোতে একবার ব্যবহার করার উপযোগী মাস্ক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
জার্মানি করোনা ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলির একটি হলেও মৃত্যুহার তুলনামূলক অনেক কম, সুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যাও বেশি৷ কিন্তু এখনও হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা হাসপাতালগুলোতে লড়ছেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে৷ ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশে লাখ লাখ মানুষ ভুগছেন শ্বাসকষ্টে৷ কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র- ভেন্টিলেটরের অভাব দেখা দিয়েছে৷
পরিস্থিতি এমন হয়েছে, কেউ পাশে এসে দাঁড়ালে মনের অজান্তেই ভয় করে৷ যদি নিঃশ্বাসে ভাইরাস ঢুকে পড়ে ফুসফুসে, বা যদি প্রশ্বাসে আমিই ছড়িয়ে দেই করোনা! কেমন একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি৷
বাংলাদেশে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে৷ এরই মধ্যে শনাক্তের সংখ্যা ছুঁয়েছে হাজারের অংক৷ হাজার মাইল দূরে বসেও প্রিয়জনদের আতঙ্ক বুকের মধ্যে টের পাচ্ছি৷
এসব চিন্তা নতুনভাবে আমাকে ভাবাচ্ছে৷ ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা' গান তো আমরা গাই৷ কিন্তু বাস্তবে কী করছি? পুরো পৃথিবীটাকে আমরা আক্ষরিক অর্থে অগ্নিস্নান করাচ্ছি৷ কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছি, অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে দিচ্ছি৷ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন কোটি বছরের পুরাতন বরফ গলায় নতুন নতুন ভাইরাসের পুনর্জন্ম হতে পারে৷
‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি' বাক্যে ছিল অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান৷ আমরা কিন্তু এমনিতেও কখনও স্মৃতি মনে রাখি না৷ কেবল জমি দখলের উদ্দেশ্যে আমরা পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন পুড়িয়ে দিয়েছি৷ কিন্তু সেটা আমাদের এখন মনে নেই৷ জমি দখলের জন্য বস্তি পোড়ানোও আমাদের কাছে এখন ডালভাত হয়ে গেছে৷ অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানল আর পুড়তে থাকা আদরমাখা চোখের কোয়ালার স্মৃতি কি আমাদের মনে আছে?
এমনকি এসো হে বৈশাখ গানটাও আমরা কেবল পয়লা বৈশাখ গাওয়ার জন্যই গাই৷ কবিগুরু যা বলতে চেয়েছিলেন আমরা তার অন্তর্নিহিত অর্থ না মেনে আক্ষরিক অনুবাদ বাস্তবে করে দেখাচ্ছি৷ অফিসে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিলাম প্রকৃতিও ঠিক একইভাবে এর জবাব দিচ্ছে রবিঠাকুরের গানেই৷ আমরা যদি প্রকৃতিবিরুদ্ধ প্রাণী হিসেবে নিজেদের বর্তমান অবস্থান না পালটাই তাহলে ‘মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক' বলে প্রকৃতি কি বাজাবে ‘প্রলয়ের শাঁখ'?
আমিই বরং দুলাইন কবিতা লিখে ফেলি- বিশের বছর বিষের জ্বালা, এর চেয়ে মোর সাতাশ ভালা৷ আজ থেকেই গ্রেগরিয়ান ২০২০ এর বিষক্ষয় শেষের শুরু হোক৷ ১৪২৭ বঙ্গাব্দে অন্তত মুমূর্ষুরা উড়ে না যাক৷ এ বছর আমি ভুলে যাওয়া গীতিই গাইতে চাই৷