মন্দা ঠেকাতে চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ
৭ অক্টোবর ২০২২বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে৷ গত ১১ বছরের মধ্যে মুল্যস্ফীতি এখন সবচেয়ে বেশি৷ এটাকে অর্থনীতিবদরা মন্দার প্রথম লক্ষণ মনে করছেন৷ তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়৷ ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় সাধারণ মানুষের৷ তারা টিকে থাকার জন্য কম খায়, কম কেনে৷ এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে৷ বাজারে চাহিদা কমে যায়৷ ফলে সরবরাহও এক পর্যায়ে কমে যায়৷ কমে যায় উৎপাদন৷ অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে যায়৷ আমদানি কমলে রপ্তানিও কমে৷ কাঁচামালের আমদানি কমলে উৎপাদনও কমে৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত ১১ বছর তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷ আগস্ট মাসে তারা মূল্যস্ফীতির হিসাব করেছে ৯.৮৬ শতাংশ৷ অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে একটু কমে তা হয়েছে ৯.১ শতাংশ৷ আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি শতকরা ১০ ভাগের ওপর৷ আবার গ্রামে শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি৷
বাংলাদেশে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০.২ শতাংশ৷ এরপর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ ভাগ ছাড়ায়নি৷ চলতি আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে তা ছাড়িয়ে গেল৷
ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এবং কর্মসংস্থান এই দুইটি সূচক দিয়ে মন্দা পরিস্থিতি বোঝা যায়৷ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যদি কমে যায় আর কর্মসংস্থান যদি না বাড়ে, তাহলে মন্দা তৈরি হয়৷ আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে৷ আর কর্মসংস্থান হলেও তা কাঙ্খিত মাত্রায় নয়৷ গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে৷ আবার প্রবৃদ্ধিও চাপের মুখে৷ আমাদের রেমিট্যান্স ওঠা-নামা করছে৷ রপ্তানি আয়ও স্থিতিশীল নয়৷ ফলে আমাদের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে৷ মন্দার অন্তত একটি ইনডিকেটর স্পষ্ট৷”
সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় দুটিই কমেছে৷ রপ্তানি ৬.২৫ এবং রেমিট্যান্স ১০ শতাংশ কমেছে৷ রেমিট্যান্স গত সাত মাসের তুলনায় সর্বনিম্ন৷ যে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয়ের ৮২ ভাগ আসে, সেখানে কমেছে ৭ শতাংশ৷
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘উন্নত বিশ্বে তো মন্দার আশঙ্কা সবাই করছেন৷ ইউরোপ-অ্যামেরিকায় তো মন্দা নিয়ে এখনই হইচই শুরু হয়ে গেছে৷ তাই যদি হয়, তাহলে আমরা রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক কোথায় রপ্তানি করবো? তবে রেমিট্যান্স প্রবাহে হয়ত অতটা ধস নামবে না৷ কিন্তু আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ নেই৷ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও হচ্ছে না৷ ব্যাংক রেট যা, তাতে তো মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে না৷ তাহলে কর্ম সংস্থান বাড়বে কীভাবে?’’
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলার৷ কোনোভাবেই ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে যেতে পারছে না৷ ডলার নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না৷ ফলে টাকার দাম কমছে৷ এর মধ্যে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করছে৷ এই পরিস্থিতির মধ্যে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি গ্রাজুয়েশন করবে৷ কিন্তু মন্দা যদি আঘাত হানে তার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি কি আছে? ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘প্রস্তুতি বলতে আমরা সবাই এটা নিয়ে আলোচনা করছি৷ কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন করে অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনীতিকে শক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে৷ দাম বাড়লেও অসুবিধা নেই, যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে৷ সেটা তো হচ্ছে না৷’’
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাপের মুখে আছে৷ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে৷ এর প্রভাব শিল্প ও কৃষিখাতে পড়ছে সরাসরি৷ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনও কমেছে৷ গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০ ভাগ৷ পোশাক খাতেও একই হারে উৎপাদন কমেছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘আমদানি কমলে হয়ত ডলার বাঁচবে, কিন্তু আমদানির বড় অংশই হলো কাঁচামাল ও মেশিনারিজ৷ এখানে আমদানি কমলে শিল্পের ক্ষতি হবে৷ তাতে আসলে রপ্তানিও কমবে৷ ভোগ, আমদানি, রপ্তানি কোনোটা কমাই অর্থনীতির জন্য ভালো নয়৷ এটা হলে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়ে৷ সেটাই তো মন্দা ডেকে আনে৷”
ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘‘মন্দার সেকেন্ডারি প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে৷ সেটা সামলানোর যথাযথ প্রস্তুতি এখনই নেয়া উচিত৷ যদি এখন না নিয়ে পরে নেয়া হয় তাহলে সেটা হয়ত কার্যকর করার সময় থাকবে না৷ ডলারের একাধিক রেট, ব্যাংকের সূদের হার এগুলো এখনই ঠিক করা দরকার৷ আর মূল্যস্ফীতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এটা দেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে চরম চাপে ফেলছে৷ বৈষম্যও তৈরি করছে৷ মানুষ তার আয় হারিয়ে ফেলছে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশ একটি সংকোচনমূলক অর্থনীতির দিকে চলে যাচ্ছে৷ সেটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো না৷ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করলে রপ্তানি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়৷ তার একটি চেইন এফেক্ট আছে৷ এতে উৎপাদন, আয়- ব্যয়, রপ্তানি, আমদানি সবই কমে যায়৷ আর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগ এবং ভোগও কমে যায়, যেটা অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়৷ ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যায়৷”
চলতি বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭. ৫ ধরা হলেও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সর্বোচ্চ ৬.৬ শতাংশ৷ এটাকেও অবশ্য এডিবি ভালো প্রবৃদ্ধি মনে করে৷
বাংলাদেশে জিডিপির প্রধান তিনটি খাত কৃষি, শিল্প এবং সেবা ঝুঁকির মধ্যে আছে৷ সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "অর্থনীতির এই অবস্থার পিছনে এখন নেগেটিভ চেইন এফেক্ট কাজ বরছে৷ বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে৷ এখন অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ এর বিকল্প হতে পারে৷ কিন্তু তার সম্ভাবনাও কম৷ রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এই দুইটি আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য, বিশেষ করে আমদানিকে ব্যয়বহুল করে তুলছে৷ এই ধরনের পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী খাতে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না৷ আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন শুধু বাধাগ্রস্ত হয় না, নতুন বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়৷”
অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘আমি মনে করি, সামগ্রিক যে পরিস্থিতি, বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন৷ তাই এর প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়তে পারে৷ সামষ্টিক অর্থনীতি, মুদ্রাবাজার, বাজার সবখানে পড়তে পারে৷ তাই একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা দরকার৷ আর সেখান থেকে এখনই পরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘এত কিছুর মধ্যেও আর্থিক ব্যবস্থাপনা যদি ঠিক করা যায়, দুর্নীতি যদি দূর করা যায়, অপচয় যদি রোধ করা যায় তাহলে হয়ত পরিস্থিতি সামলানো যাবে৷”
২৫ সেপ্টেম্বরের ছবিঘর দেখুন...