মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যুবলীগ এবং অতি চালাকি
২১ মার্চ ২০২১তবে অনেকে নিজের প্রয়োজনে এ দাবিতে সোচ্চার হয়ে অন্যের বেলায় তা বেমালুম ভুলে গেলেও দাবিটির গুরুত্ব চিরকাল থাকবে৷
শাল্লায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি শুধু নিভৃতে কাঁদেনি, প্রথমে বৃহত্তর স্বার্থে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করেছে, তারপর আগুনে পুড়েছে, রাম দার কোপও খেয়েছে৷ এক যুবক একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, সেই স্ট্যাটাসে বিক্ষুব্ধ হয়ে শত শত মানুষ আগের রাতেই হামলা চালাতে গিয়েছিল৷ সুনামগঞ্জের সেই গ্রামের সংখ্যালঘুরা স্ট্যাটাসদাতার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে, বুঝিয়েসুঝিয়ে হামলায় উদ্যত মানুষদের ফেরত পাঠিয়েছিলেন৷ তখন গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কথা দেয়া হয়েছিল যে, স্ট্যাটাস দেয়া যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে৷
যুবকটিকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয় সেই রাতেই৷
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তখনও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি৷ কেউ থানায় গিয়ে অভিযোগও জানায়নি৷ তবু একজনের একটি মত প্রকাশের ‘অপরাধে’ শত মানুষের ‘শাস্তি’ এড়াতে, মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা চালাতে যাওয়া মানুষগুলোর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে গ্রামবাসী সেই রাতেই যুবকটিকে থানায় পৌঁছে দিয়েছিল৷ নিষ্ক্রিয় পুলিশ যুবকটিকে গ্রেপ্তারও করেছিল৷
কিন্তু এত করেও লাভ হয়নি৷ পরের দিন ঠিকই হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের গ্রামে৷ যার স্ট্যাটাসে ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা বলে রাতে হামলার চেষ্টা হয়েছিল, তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েও প্রাণ আর সামান্য মান ছাড়া বলতে গেলে কিছুই রক্ষা করতে পারেনি সংখ্যালঘুরা৷ রাত পোহাতেই লাঠিসোঠা, রামদা নিয়ে ছুটে গিয়ে কিছু মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে লাঠি, রামদা আর লুটপাট চালিয়েছে৷ আর আমরা দেখেছি বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হতে, এমনকি হামলার শিকার হতেও প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস না দিলেও চলে৷
এমন অবশ্য অতীতেও ঘটেছে৷ ভোলায় এক সংখ্যালঘু যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে (পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত) তার হয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়া, সেই যুবক থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি জানানো এবং গ্রেপ্তার হওয়ার পরও হামলা, সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনা তো সামান্য পুরোনো!
কিন্তু মুশকিল হলো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিটি ঘটনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে শুধু দায় এড়ানো আর নিজেদের সাধুসন্ত প্রমাণের প্রতিযোগিতা৷
এবারও তাই হচ্ছে৷ মাইকের ঘোষণা শুনেও সক্রিয় না হয়ে পুলিশ যে হামলা হতে দিয়েছে তা স্বীকার করার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছাও তাই দেখা যায়নি৷ হামলাকারীদের অনেকেই যে হেফাজতের সমর্থক, তা স্বীকার করার সামান্যতম সৎসাহসও দেখায়নি হেফাজতে ইসলামী কর্তৃপক্ষ৷ অথচ এক যুবক হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণেই আগের রাতে শত শত মানুষ হামলা চালাতে গিয়েছিল৷ তাদের অনেকের মাথার ব্যাজ, মুখের স্লোগান- সবই ছিল হেফাজতের পক্ষে৷
পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, এক যুবলীগ নেতাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও তাতে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে- এমনটি আশা করা যাচ্ছে না৷
প্রথমত, মামলা হয়েছে দুটি৷ একটির বাদি হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল৷ ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো ১০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তিনি৷ অন্য মামলাটি করেছে পুলিশ৷ সেখানে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে৷ পুলিশের মামলাটিতে নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও গ্রেপ্তারের আশঙ্কা অনেক বেশি৷
সংখ্যালঘুদের ওপর অতীতের সব হামলার মতো এই হামলারও বিচার না হওয়ার আশঙ্কা জাগাচ্ছে সমাজের বাদবাকিদের অধিকাংশের সাবধানী প্রতিবাদ কিংবা সুকৌশলে ঘটনাকে হাল্কা করে দেয়ার চেষ্টা৷
কয়েকজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েই পুলিশ বা সরকার যেমন ‘সব দায়িত্ব পালিত’- এমন বার্তা দিতে পারে না, অন্যরাও তেমনি এক যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে বলেই সব দায় শুধু যুবলীগ বা সরকারি দলের- এমন যুক্তিতে নির্মোহ, নিঃস্বার্থ সব মানুষের সমর্থন আশা করতে পারে না৷
তাতে বড় জোর নিজেদের অতি চালাক এবং জনগণকে অতি বোকা ভাবার চেষ্টা করা হয়৷
জনগণ এবং বিশ্ববাসী কিন্তু এত বোকা নয়৷
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল বা তাদের ওপর হামলায় যে সব দলেরই কম-বেশি অংশগ্রহণ থাকে, সরকারের ‘আপোষ' ছাড়া এসব যে যুগ যুগ ধরে চলতে পারে না এবং হেফাজতে যে বেশ কয়েকটি দলের নেতারাও আছেন- এসব কিন্তু অনেকেই জানেন!