ভারত-চীন সংঘাত নিয়ে অধিকাংশ দেশই চুপ
২৪ জুন ২০২০ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পর দশদিন কেটে গেছে। সাধারণত, বড় কোনও সংঘাতের ঘটনা ঘটলে, এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া চলে আসে। কে কার পাশে দাঁড়িয়ে, তা অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়। কিন্তু ভারত-চীন সংঘাতের পর সেই চেনা ছকে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। চীন ও ভারতের পাশে দাঁড়ানোর কথা অন্তত খোলাখুলিভাবে কেউ জানায়নি।
অ্যামেরিকা, জার্মানি, জাপানের মতো কয়েকটা দেশ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জার্মানি এবং জাপান মোটামুটি একসুরে দুই দেশকে উত্তেজনা কমিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ফেরাবার কথা বলেছে এবং আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে বলেছে। ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছেন, অ্যামেরিকা দুই দেশের সঙ্গেই কথা বলছে। ওদের বড় ধরনের সমস্যা আছে। তারপর ট্রাম্প যথারীতি মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, ভারত কখনই মধ্যস্থতার প্রস্তাব মানবে না। চীনও নয়। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনি মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন। তখনও কেউ মানেনি। এটা বলতে হয়, তাই বলার মতো ব্যাপার। ভারত বা চীন কারও পক্ষ নিয়েই ট্রাম্প অন্তত কিছু বলেননি।
বরং মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পিও বলেছেন, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ভারতের সঙ্গে সীমান্তে টেনশন বাড়িয়েছে। সাউথ চায়না সি-তে চীন বেআইনিভাবে প্রচুর প্রচুর ভূখণ্ড দাবি করছে এবং সেখানে সামরিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এলাকায় চীন অস্থিরতা তৈরি করছে। পম্পিও তাও কিছুটা চীনকে দায়ী করেছেন। তবে তাঁর উদ্বেগ ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষের থেকে সাউথ চায়না সমুদ্রের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অনেক বেশি। ভারতের এইটুকু স্বান্ত্বনা থাকতে পারে, পম্পিও অন্তত মৌখিকভাবে সংঘর্ষের জন্য চীনকে দায়ী করেছেন।
কিন্তু বাকিরা সেটাও করেনি। পশ্চিমা দেশগুলি হয় চুপ, না হয় নিরাপদ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। জার্মানি তাও দুই দেশকে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন সহ অন্য বেশিরভাগ দেশ সেটাও করেনি। হয় তাঁরা এই বিরোধকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চায়নি, অথবা তাঁরা এখনই চীন বা ভারত কোনও পক্ষের দিকে নিজেদের ঝোঁকের কথা জানাতে চায়নি।
রাশিয়া পরিস্কার করে দিয়েছে, তাঁরা দুই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। তাঁরা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাবার চেষ্টাও করছে। ফলে রাশিয়াও ভারত বা চীন কোনও পক্ষের দিকে ঝুঁকে নেই। তাঁরা দুজনের সঙ্গেই থাকতে চাইছে।
এখনও পর্যন্ত ভারতের কোনও প্রতিবেশী দেশ এই সংঘাত নিয়ে একটা কথাও বলেনি। তাঁরা এই বিষয়ের মধ্যেই ঢুকতে চায়নি। এটা ঘটনা যে, অধিকাংশ প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। পাকিস্তান ও চীনের কথা বাদই দেওয়া গেল, সম্প্রতি নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই তিক্ত হয়েছে। ভারতের অভিযোগ, তাঁদের ভূখণ্ডকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে নেপাল নতুন ম্যাপ সংসদে পাস করে চালু করে দিয়েছে।এই বিতর্ক যখন চলছে, তখন ভারতের সেনা প্রধান বলে দিয়েছিলেন, চীনের ইশারায় নেপাল এই কাজ করেছে। এটা নিয়ে কোনও আলোচনার রাস্তায় ভারত যায়নি, বরং নেপালকে কার্যত চীনের দিকে ঠেলে দিয়েছে তাঁরা। অথচ, এই নেপালের সঙ্গে ভারতের অসম্ভব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ট এমন নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু সেখানেও বাংলাদেশের ক্ষোভ হলো, তাঁরা ভারতকে যে সুবিধা দেয়, বিনিময়ে তার কিছুই পায় না। তিস্তা চুক্তি হয়নি। সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়েও বাংলাদেশের প্রচুর ক্ষোভ আছে। ফলে প্রতিবেশীরা উচ্চকিতভাবে ভারতকে সমর্থন করবে এমন মনে করার কোনও জায়গা নেই। করেওনি। শুধু ভারতের কাছে এটুকুই স্বস্তি, তারা ভারতের বিরুদ্ধাচরণ করেনি এবং চীনের পক্ষে দাঁড়ায়নি।
আসলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এখন আমূল বদলে গিয়েছে। এখন বিভিন্ন দেশের সম্পর্কে অর্থনৈতিক বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি অ্যামেরিকা এবং দ্বিতীয় শক্তি চীনের মধ্যে আর্থিক সম্পর্কের বন্ধন এতটাই বেশি যে, ডনাল্ড ট্রাম্প ইচ্ছে করলেই চীনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ভারতের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়বেন না। আর দিন কয়েকের মধ্যেই পম্পিও চীনের সঙ্গে আলোচনাতেও বসবেন। তবে তার মানে এই নয় যে, অ্যামেরিকা কখনই চীনের বিরুদ্ধে যাবে না। অবশ্যই যাবে। তাঁরা চীনকে চাপে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই বিরোধিতারও একটা মাত্রা থাকবে। ভারত-চীন সংঘাতের পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে সেটা সহজবোধ্য।
এটা শুধু অ্যামেরিকার জন্য সত্যি তা নয়, বিশ্বের বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সত্যি। যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলতি মাসে ভারতের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের চুক্তি হয়েছে, তারাও বানিজ্যিক দিক থেকে চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সাউথ চায়না সমুদ্র নিয়ে তাঁদেরও প্রচুর অসন্তোষ আছে। অস্ট্রেলিয়া চায় তারা অ্যামেরিকা, জাপান ও ভারতের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়াতেও অংশ নেবে। এ সবই চীনকে চাপে রাখার জন্য।
চীনের সঙ্গে জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলির সম্পর্ক ভালো নয়। তারপরেও এই সংঘর্ষের পর তারা মুখ বুজেই আছে।
বিদেশ সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রণয় শর্মা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''চীনের আসল সংবাদমাধ্যম হলো শিনহুয়া, পিপলস ডেইলি। সেখানে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। শুধু গুরুত্বহীন গ্লোবাল টাইমসে কিছু খবর বেরিয়েছে। তাঁদের মনোভাব হলো, এটা চীনের এলাকা। তারা নিজেদের এলাকায় আছে। ফলে পরিস্থিতিটা যুদ্ধের দিকে যাবে বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের ভাবনার সঙ্গে চীনের মনোভাব অন্তত মিলছে না।''
প্রণয়ের মতে, আন্তর্জাতিক দুনিয়া হংকং নিয়ে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিরোধ নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। তাই তারা ভারত-চীন সংঘর্ষের ঘটনাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি।
কিন্তু এই সংঘাত, উত্তেজনা ভারতের পক্ষে অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে যাখানে ২০ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে এবং তা নিয়ে রাজনীতিও গরম হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের ভিতরে চীনের জিনিস বয়কট করার মতো গিমিক চলবে। কিছু ফটো অপও হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল। করোনা তাকে শোচনীয় করে ফেলেছে। ১২ কোটির বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। প্রবৃদ্ধির হার শূন্য় বা নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। ফলে ভারতকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক বড় লড়াই লড়তে হবে। চীনের সঙ্গে সংঘাত বাড়ানো নিজের স্বার্থেই কাঙ্খিত নয়, সম্ভবও নয়।
সেই সঙ্গে প্রশ্নটা অবশ্য অন্য জায়গায় উঠছে। সেটা বিদেশনীতি নিয়ে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থকে চীন ও অ্যামেরিকার মধ্যে একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলছিলেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সঙ্গে তিনি ছয় বছরে ১৮ বার বৈঠক করেছেন। মোদী চীনে গিয়েছেন। জিনপিং একাধিকবার ভারতে এসেছেন।
এক অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকের মতে, ভারত এখন অ্যামেরিকার দিকে অনেকটাই ঝুঁকে আছে। ইউপিএ আমল থেকে এই প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। মোদীর আমলে তা আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টাও সমানভাবে হয়েছে। কারণ, সেটাই বাস্তবতা। ভবিয্যতেও একই নীতি নিয়ে চললে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাম নেতার মত হলো, নরেন্দ্র মোদীকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁকে আন্ডারএস্টিমেট করাটাও উচিত হবে না। ভারতীয় সীমান্তে চীন ঢোকেনি, কোনও পোস্টও অধিকার করে নেই কথাটা ভেবেচিন্তেই বলেছেন তিনি। মোদীর একটা লক্ষ্য আছে। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সমস্যাকে ঠিক করার কৃতিত্ব নেওয়া। তাঁর সময়ে রামমন্দির সমস্যার সমাধান হয়েছে। ৩৭০ ধারার বিলোপ হয়েছে। কাশ্মীর নিয়েও তিনি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ বার চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যাও মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা তার মধ্যে রয়েছে। আলোচনা করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাকে সীমান্ত করে ফেলার উদ্যোগ মোদী নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
একটা কথা ঠিক, বর্তমানে বিদেশনীতি হলো নিজের স্বার্থ বাঁচিয়ে যতটা সক্রিয় হওয়া দরকার সেটা হওয়া। মোদী একটা কথা ভালো করে জানেন, চীনের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে ভারতের লাভ নেই। দুই দেশের শক্তি অসম। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ঠিক আছে, সেখানেও যুদ্ধ করে লাভ নেই। তাতে ভারতেরই ক্ষতি। সংঘর্ষের পর ভারত যদি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইত তো ব্রিকস থেকে, সাংহাই কোঅপারেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। সেরকম কিছুই হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী এমন একটা মন্তব্য করেছেন, যাকে চীনের মিডিয়া ও বিশ্লেষকরাও স্বাগত জানিয়েছেন। ফলে বর্তমান বিদেশনীতি বদল করা নয়, বরং বাস্তব মেনে ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মেটাবার দিকে মোদী এগোলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।