‘বিশ্ববাসীকে সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝানোর মাধ্যম প্রত্নতত্ত্ব’
৩ এপ্রিল ২০১৭ডয়চে ভেলে: বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামো ক'টি?
আলতাফ হোসেন: সব অধিদপ্তরের একটি সাংগঠনিক কাঠামো থাকে৷ সে হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরেরও একটিই সাংগঠনিক কাঠামো৷ তবে ডিভিশন আছে চারটি৷ একটি বগুড়ায়, একটি খুলনায়, একটি কুমিল্লায় ও একটি ঢাকায়৷
বর্তমানে প্রকল্প আছে কতগুলো?
এই মুহূর্তে একটি প্রকল্পও নেই৷ একটি ছিল সাউথ এশিয়ান টুরিজম প্রোজেক্ট৷ সেটা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে৷ এই প্রকল্পের আওতায় আমরা চারটি বড় কাজ করেছি৷ একটি হলো আমাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ যে দু'টি জায়গা আছে – পাহাড়পুর ও ষাটগম্ভুজ মসজিদ – সেখানে আমরা কাজ করেছি৷ সেই সঙ্গে মহাস্থানগড় ও কান্তজিউ মন্দিরে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য কিছু কাজ করেছি আমরা৷ আগামী জুলাই থেকে আরো একটি প্রকল্প শুরু হবে৷ এছাড়া ছোট ছোট কিছু কর্মসূচি আছে৷
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গেজেটভুক্ত পুরাকীর্তির সংখ্যা কত এবং জাদুঘর কতগুলো?
গেজেটভুক্ত পুরাকীর্তির সংখ্যা এখন ৪৫৫টি আর জাদুঘর আছে ১৭টি৷ এর মধ্যে বেশ কিছু আছে অনেক পুরনো জাদুঘর, যেগুলো ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তৈরি হয়৷ যেমন পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় এবং ময়নামতির জাদুঘরগুলো অনেক পুরনো৷
জাতির জীবনে পুরাকীর্তির গুরুত্ব কী?
আমাদের সংবিধানের ২৩ ও ২৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে৷ শুধু জাতির জীবনে নয়, সামাজিক জীবনে নয়, আমাদের সংস্কৃতির মূল ঐতিহ্যই হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব৷ বিশ্ববাসীকে বা দেশবাসীকে যদি জানাতে হয় আমাদের সংস্কৃতি কত পুরনো, তাহলে তার একটাই মাধ্যম৷ আর সেটা হলো প্রত্নতত্ত্ব৷ ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে বলি৷ ধরুন পুণ্ডবর্ধন, যেটা আমাদের রাজধানী ছিল৷ সেই সময়টা বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যাবে যে, তৎকালীন রাজা তাঁর জনগণকে বলছেন – ‘তোমরা তোমাদের গোলার ধান কৃষকদের দিয়ে দাও, কারণ মহামারি লেগেছে৷ আবার ফসল ভালো হলে আমি তোমাদের গোলা ভরে দেবো৷' এটা কিন্তু আজ থেকে দু'হাজার বছর আগের কথা৷ শুধু এটা নয়, আমরা যেখানেই খনন করছি, এখন যেমন ওয়ারিতে খনন করছি, সেখানে আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৬০০ বছর পুরনো নিদর্শন পাচ্ছি৷
প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও খননে কি আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়?
বেশ কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷ কখনও পুরনো পদ্ধতি, আবার কখনও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়৷ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা আধুনিক পদ্ধতির দিকে যাচ্ছি৷ মনে রাখতে হবে, আমরা মাটির নীতে যেসব পাচ্ছি – মানে ইটের, টালির বা ছোট ছোট পাথরের জিনিস – সেগুলো সংরক্ষণ করাটা কঠিন৷ কারণ আমাদের দেশে পানির লেভেল অনেক ওপরে৷ খনন করার কিছুদিন পরই বর্ষকালে এগুলোতে পানি উঠে যায়৷ এতে এগুলো নষ্ট হতে পারে৷ তবে উত্তর ভারতে এই ধরনের সমস্যা নেই৷ কারণ সেখানে যে প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া যায়, সেগুলো পাথরের৷ কয়েক হাজার বছর আগে সেখানে পাথর দিয়েই কাজ হতো৷ কিন্তু আমাদের কোনো পাথরের কাজ নেই৷ এখানে যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলো ইটের৷ ইটের সঙ্গে হয় কাদামাটি বা চুন-সুরকির৷ ফলে এগুলো সংরক্ষণ করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়৷ যেটা কাদামাটি, সেটা কাদামাটি দিয়েই সংরক্ষণ করতে হবে৷ তা না হলে সঠিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ হবে না৷
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় বাংলাদেশের কতগুলো স্থান রয়েছে?
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কয়েক রকমের হয়৷ একটি স্পর্শযোগ্য এবং আরেকটি অস্পর্শযোগ্য বা মনোগত সাংস্কৃতির ঐতিহ্য৷ আরেকটি আছে ন্যাচারাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷ বাংলাদেশে স্পর্শযোগ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে দু'টি৷ একটি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার এবং আরেকটি বাগেরহাটের মসজিদ শহর৷ ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়৷ এরপর ১৯৯৯ সালে যে সম্ভব্য তালিকা হয়েছে, সেখানে পাঁচটি আছে৷ আর আমাদের ন্যাচারাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো সুন্দরবন৷ অস্পর্শযোগ্য বা মনোগত সাংস্কৃতির ঐতিহ্য হলো লালন, জামদানি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা৷
প্রত্নসম্পদ খননে সরকারি না বেসরকারি উদ্যোগ বেশি লক্ষ্য করা যায়?
প্রত্নতত্ত্ব হলো সরকারের সম্পদ৷ তাই সারা পৃথিবীতে এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগটাই বেশি থাকে৷ আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগেও একটা-দু'টো কাজ হচ্ছে৷ বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সাংস্কৃতির মন্ত্রণালয়ের অনুদান নিয়ে কিছু খনন করে থাকে৷ তবে এটাও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হয়৷
জাদুঘর থেকে অনেক সময় প্রত্নসম্পদ চুরি হয়ে যায়৷ এর কারণ কী?
এটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভালো বলতে পারবে৷ তবে জাদুঘর থেকে এই ধরনের প্রত্নতত্ত্ব চুরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ হয়ত কোনো সময় দু-একট চুরি হয়ে থাকতে পারে৷ অবশ্যই সেটা নিয়ে থানায় মামলা হবে, থানা সেটা তদন্ত করে দেখবে৷
অনেক সময় বলা হয়, সব প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ করতে গেলে দেশে জমির অপচয় হবে৷ এই ধরনের ধারণা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ করতে গেলে বেশি জমির দরকার হয় না৷ প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ যেখানে আছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি, সেটা কৃষি জমি নয়৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা আছে যে, কৃষি জমি যতটা সম্ভব কম নষ্ট করে প্রত্নসম্পদ রক্ষা করতে হবে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা পাওয়া যায়, সেখান উঁচু ঢিবি থাকে, কিছু গাছ থাকে৷ কৃষি জমিতে থাকলে এটা নষ্ট হয়ে যেত৷ সর্বশেষ নীলফামারীর ধর্মপালে আমরা যে মন্দিরটা পেয়েছি, সেটাও একটা উঁচু জমিতে৷
বিদেশ থেকে কি কোনো পুরাকীর্তি আনা হয়? বিদেশি পুরাকীর্তি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আছে এখানে?
বিদেশ থেকে পুরাকীর্তি আনার বিষয়টি ভ্যারি করে কান্ট্রি-টু-কান্ট্রি, মানে সে দেশের আইন অনুযায়ী৷ কেউ পুরাকীর্তি রপ্তানি করতে পারে না, আমরাও পারব না৷ এর কোনো আইন নেই৷ তবে কোনো দেশের সঙ্গে ইটারচেঞ্জ করে দু-একটা পুরার্কীতি রাখা যেতে পারে৷ আমরা বলতে পারি, তোমাদের একটা পুরার্কীতি আমাদের দাও আর আমাদের এটা তোমরা নাও৷ তখন সেটা আমরা সংরক্ষণ করতে পারি৷ তবে এখনো পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি৷
এই পুরার্কীতির দেখভালে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল কি আছে বাংলাদেশের? যাঁরা প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করে, তাঁদের কি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আছে?
এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন৷ আমাদের যত পুরার্কীতি আছে, সেই পরিমাণ জনবল নেই৷ আমরা মানুষ বাড়াতে চেষ্টা করছি, সরকারও দিচ্ছে৷ যেখানে আমাদের জনবল দরকার আমরা চাইলে সরকার সেটা দিচ্ছে৷ এছাড়া নতুন নতুন ‘সাইট' আবিষ্কার হচ্ছে, সেখানে নতুন জনবল লাগছে৷ তবে শুধু জনবল হলেই তো হবে না, তাঁদের প্রশিক্ষণও তো লাগবে৷ তাই আমরা চেষ্টা করছি, এই জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে৷ বিশেষ করে খননের কাজে, সংরক্ষণের কাজে৷ আসলে দু'টোই আমাদের জন্য খুব জরুরি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন মন্তব্যে৷