প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ নয়, ধ্বংস হচ্ছে
৪ এপ্রিল ২০১৭১. এরপরও অবশ্য বলা যায় না যে, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে৷ বিশেষ করে দৃশ্যমান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায়িত্বশীলরা যে কতটা উদাসীন তার দু'টি নমুনা দেওয়া যাক৷
ক. বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফ্রান্সের গিমে মিউজিয়ামকে বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো পুরাকৃর্তি নিদর্শন পাঠানো হয়েছিল৷ পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ৷ কতগুলো পাঠানো হয়েছিল, সবগুলো ফেরত আনা হয়েছিল কিনা, আনা-নেওয়ার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিনা, আজও এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি৷ উত্তর জানা যায়নি পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যৌক্তিকতারও৷ দেশের মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও, কাজটি করা হয়েছিল মূলত আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে৷
খ. বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর সামনে যে মানুষটি সাহিত্য দিয়ে পরিচালিত করে গেছেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক কুঠিবাড়ি৷ পদ্মার পাড়ের এই কুটিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আসতেন, থাকতেন৷ তাঁর সাহিত্যের বহু কিছু তিনি এখানে বসে লিখেছেন৷ কুঠিবাড়িটি ছিল লাল ইটের তৈরি৷ কয়েক বছর আগে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে বাড়িটি সাদা রং করা হয়েছে৷ আমাদের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের মানসিকতা,এই ঘটনাটি দিয়ে খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়৷
২. উয়ারি-বটেশ্বরসহ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নানা কিছু সন্ধান করে বের করা হচ্ছে, যা প্রশংসার৷ তবে যা দৃশ্যমান আছে, সেগুলোর অবস্থা বড়ই করুণ৷ দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির৷ ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই মন্দিরটির সংরক্ষণের অবস্থা মোটেই সন্তোজনক নয়৷ পোড়ামাটির নান্দনিক শিল্পকর্মগুলোর অনেক কিছুই চুরি হয়ে গেছে, খুলে পড়েছে৷
রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজবাড়িতেও এমন কিছু ছোট-বড় মন্দির আছে৷ সেগুলোর সংরক্ষণ অবস্থাও বড়ই করুণ৷ পুঠিয়ার রাজবাড়ির অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে৷ আবাসিক বাড়ি তৈরি হয়েছে, রাজবাড়ি এলাকার ভেতরে৷
জয়পুরহাটের পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, বেহুলা-লক্ষিন্দরের সেই কিংবদন্তি....কোনো কিছুর সংরক্ষণের প্রতি যে গুরুত্ব থাকা প্রত্যাশিত ছিল, তা নেই৷
পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ সব করেছে, প্রশাসনের সহায়তায়৷
৫০০ বছরের পুরনো শৈল্পিক সৌন্দর্যের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কাগজে-কলমে গুরুত্ব পেলেও, বাস্তবে গুরুত্ব খুবই কম৷
৩. পাকিস্তানিদের কাছে এ সব নিদর্শনের কোনো গুরুত্ব ছিল না৷ ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল, ১১ বছর সময় নিয়ে নির্মিত হয়েছিল নাটোরের দিঘাপাতিয়ার রাজবাড়ি, যা উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত৷ তুলনামূলকভাবে উত্তরা গণভবনের ব্যবস্থাপনা এখনও ভালো৷ সেই আমলের আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে কেরসিনের ফ্যান – সবই সংরক্ষিত হয়েছে৷
১৯৬৫ সালে মোনায়েম খান উত্তরা গণভবনের নকশায় একটি বড় পরিবর্তন আনেন৷ তিনি মন্দিরের মতো দেখায় এমন অংশ ভেঙে মসজিদের গম্বুজের মতো অংশ সংযুক্ত করেন, যা মূল নকশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷
বাংলাদেশ আমলে উত্তরা গণভবন নাম দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়৷ ফলে ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো৷ তবে স্বাধীন বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের দিকটি সব সময় অবহেলিতই ছিল৷ এখনও যে তার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাবে না৷ শুধু বলা যাবে যে, এক ধরনের সচেতনা তৈরি হয়েছে৷
আপনি কি গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে একমত? লিখুন আমাদের৷