একটা সময় শুধু ঢাকা শহরের বেইলি রোডে একসঙ্গে বেশ কিছু ফাস্টফুডের দোকান ছিল৷ চাইনিজ রেস্তোরাঁ বলতে ক্যান্টন, চাংপাই আর মিডনাইট সান৷ পরে চেইন রেস্তোরাঁয় জিনজিয়ান যুক্ত হয়৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্য চাহিদার বদল, চাওয়া পাওয়ার নানা পরিবর্তনে এই দেশে রেস্তোরাঁ শিল্পে তুমুল বদল এসেছে৷ মানুষের খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথা বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে রেস্তোরাঁ রয়েছে- চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪৷ ৬৪ জেলা ধরে হিসাব করলে গড়ে প্রতি জেলায় সাত হাজারের বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে৷ তবে গড়ের হিসাব ঠিক হবে না৷ ঢাকা শহরেই লাখ দুয়েক রেস্তোরাঁ রয়েছে৷ অবশ্য এই হিসাবে গলির মোড়ের পুরি- সিঙ্গারার দোকানও ধরা হয়েছে৷
ঢাকা শহরে এখন মানুষের বিনোদন বলতে শুধুমাত্র রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চেক-ইন দেওয়া৷ তাই মানুষের চাহিদার সঙ্গে এইসব হোটেল-রেস্তোরাঁ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে৷ কিন্তু এইসব স্থানে আপনাকে আপনাকে কী খাওয়ানো হয় আপনার সাধ্যের মধ্যে কখনো ভেবে দেখেছেন?
হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার বাড়ির তৈরি খাবার থেকে সস্তা হয় প্রায়শই৷ কিন্তু কীভাবে এত সস্তায় খাবার দেওয়া সম্ভব এটা সবসময়ই প্রশ্নের বাইরে থেকে গেছে৷ নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন, ভেজালবিরোধী অভিযানের পরপরই আমরা কিছুটা জানতে পেরেছি৷ খুব সামান্যই নজরে এসেছে আমাদের৷ তবে আদৌ কি আমরা পুরো চিত্রটা পেয়েছি কখনো? খাদ্যে ভেজাল মেশানোর কোন পর্যায়ে আমরা রয়েছি শুধু মাত্র সস্তায় ক্রেতা ধরার তাগিদে তার সামান্য একটু নমুনা দেখুন-
বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী- বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়৷ ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে৷ আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে৷ এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়৷ সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ৷
উৎপাদন ব্যয় কমাতে বেকারির খাদ্যপণ্যে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিমসহ নিম্ন বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়৷ বেকারির কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙসহ নানা কেমিক্যালও ব্যবহার করতে দেখা যায়৷ পানীয়তে মেশানো হচ্ছে কেমিক্যাল৷ চিনি সাদা করতে ফসফেট, মুড়িতে ইউরিয়া, মসলায় রঙ, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হয় নিয়মিত৷
গোলমরিচের মতো মশলায় পেঁপের বিজ, চা-কফিতে কাঠ বা তেঁতুল বীজের গুঁড়া ব্যবহার খুবই নিত্য বিষয়৷ রেস্তোরাঁয় ও বাড়িতে ব্যবহার হওয়া বাটার বা ঘিতে থাকে সেদ্ধ আলু, পাকা কলা ও কেমিক্যাল প্রিজার্ভেটিভ৷ অন্যদিকে দামি ডালে খেসারির ডাল, বেসনে সস্তা আটা, ভাজা ছোলায় কোলটার ডাই, সুজিতে লোহার গুঁড়ো মেশানো হয়৷ আটা ও ময়দায় চকের গুঁড়ো থাকে দামে সস্তা করার জন্য৷
এইসব ভেজাল পণ্য দিয়ে তৈরি খাবারই রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত হয়৷ লাভের আশায় রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ আরও দুই কাঠি ওপরে চলাচল করেন৷ ধরেন আপনি মুরগির কোনো একটি পদ খাবেন৷ এমনিতেই মুরগিকে প্রোটিন ইনজেকশন দিয়ে মোটাতাজা করা হয়, এতে মুরগির মূল উপাদানে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বলে দাবি করেন গবেষকরা৷ তার ওপর দীর্ঘদিন ফ্রিজে রেখে মেয়াদহীন মাংস কিংবা জীবিত মৃত সব ধরনের মুরগি দেদার ব্যবহৃত হয় রেস্তোরাঁতে এবং নানা পদের ভেজাল মিশ্রিত মসলা বা কাপড় ডাই করার রঙ দিয়ে রান্না হয় মুরগি৷ এতে যে তেলটি ব্যবহার হয় সেটিও ভোজ্য তেল নয়৷ এতে ডালডা বা প্রাণিজ চর্বি ব্যবহার করা হয়৷ নিরাপদ খাদ্য অভিযানে ভেজাল তেল বের করে ফেলে দেওয়া, কাপড়ের রঙ দেওয়া খাবার ফেলে দেওয়ার গল্প তো অহরহ৷
এই তো সম্প্রতি এক রেস্তোরাঁয় খাদ্যে কাপড়ের রঙ ব্যবহার করে ভেজালবিরোধী অভিযানে জরিমানা দেন৷ এইসব রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফুঁসে ওঠে সেইসময়৷ তারা তাদের বিজ্ঞাপন লেখেন- ‘আমরা বিরিয়ানিতে খাবারের রঙ মিশাই না৷’ তার এক সপ্তাহ পর রঙ না মেশানো একটি রেস্তোরাঁ অভিযুক্ত হয় বিরিয়ানিতে খাসীর মাংসের পরিবর্তে কুকুর বা বেড়ালের মাংসের ব্যবহার করার৷ এটি একটি অবাস্তব অভিযোগ৷ ঢাকা শহরে বেড়াল বা কুকুর চাষ করা হয় না, একইসঙ্গে ফুটপাতের কুকুরের মতো হিংস্র প্রাণীকে জবাই করে প্রসেস করার বিষয়টিও প্রায় অসম্ভব৷ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন পাইকারি ১,১০০ টাকা কেজি দামের খাসীর মাংসের বিশাল সমাহারে কীভাবে ৪০০-৫০০ টাকায় বিরিয়ানী দেওয়া সম্ভব হয় যদি না এগুলো লাওয়ারিশ কুকুর বেড়াল হয়৷ অনেকে ছোট ছোট হাড়ের উল্লেখ করেছেন৷ এইসব রেস্তোরাঁতে মাংস কেনার ক্ষেত্রে দাম কমাতে একেবারেই কম ওজনের ছাগল কেনা হয়, অনেক সময় কেনা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ফ্রোজেন মাংস৷ যদিও মাংসের আমদানি সরকার বন্ধ রেখেছে কিন্তু পাইকারি বাজারে ফ্রোজেন মিট বিক্রি হয় হরহামেশা৷ এইসব মাংসের দাম অনেক কম থাকে৷ এবং মান ও মেয়াদোত্তীর্ণ থাকে বেশিরভাগ সময়৷ এসব মাংস প্রসেসে ব্যবহার করবেন হরেক রকম কেমিক্যাল যুক্ত সস, ইটের গুঁড়া মেশানো মশলা, কাপড়ের রঙ আর সবশেষে রান্না করবেন ভেজাল মেশানো ভোজ্য তেল দিয়ে৷ ভীষণ মুখরোচক একটি খাবার আপনার প্লেটে হাজির৷
মাঝে মধ্যে এর মধ্যে তেলাপোকা, কিংবা জানা বা অজানা পোকা পেয়ে আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই করবেন৷ কিন্তু রেস্তোরাঁর বসার জায়গার নান্দনিকতা দেখে ভেতরের অবস্থা কী সে বিষয়ে কখনোই প্রশ্ন করবেন না৷ ফুচকার মতো স্ট্রিটফুড, বেকারির বিস্কুট কিংবা লাচ্ছা সেমাই তৈরির জায়গাগুলো নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনের আগে যেমন কেউই জানতেন না কোথায় তৈরি হয় এসব খাবার৷ তেমনি বড় বড় রেস্তোরাঁর কিচেন না দেখলে কখনো বিশ্বাসই করবেন না কতটা নোংরা পরিবেশে আপনার জন্য তৈরি হচ্ছে কাচ্চি বা চিকেন পারমিজানের মতো মুখরোচক খাবার৷ আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁ নিয়ম অনুযায়ী কিচেনে টয়লেট থাকতে পারবে না৷ কিন্তু ঢাকার বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর কিচেনে থাকে টয়লেট, সেখানেই কর্মীরা যাচ্ছে শৌচকর্ম সারতে পাশাপাশি রান্নার যাবতীয় ধোয়ার কাজও সেখানেই হচ্ছে৷ হাতে গোনা অল্প কয়েকটা রেস্তোরাঁর কিচেনের পরিবেশ সুন্দর৷ কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই৷ আমরা শুধু ইয়াম্মি বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতেই ব্যস্ত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতা শূন্যের কোটায় বলে এইসব দিকে কখনো নজর দেই না বা প্রতিবাদ করি না৷
অবশ্য প্রায় সাড়ে চার লাখ রেস্তোরার পরিবেশ ঠিক করতে কতশত কর্মী প্রয়োজন সেটির ব্যয় বহন করতে আদৌ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ রাজী কিনা এগুলো সবই দেখার ও ভাববার বিষয়৷ কারণ একজন কর্মী মানেই তার সারাদিনের খাওয়ার খরচ, বেতন, থাকার খরচ, এর সঙ্গে ক্লিনিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যয়৷ এতটা খরচ কেউই করতে ইচ্ছুক নয় লাভের দুনিয়ায়৷
কথিত আছে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ৪০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ থাকে৷ ব্যক্তিগত ক্যাটারিং অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ভেজাল এড়িয়ে শতভাগ ভোজ্য খাদ্যপণ্য ও পরিচ্ছন্ন কিচেনে ফুড গ্রেডের বাসনে খাবার দিতে গেলে আপনার লাভের চিন্তা দূরে খরচ উঠিয়ে আনাটাই মাঝে মাঝে দূরহ হয়ে পড়ে৷ একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাই এসব ঝামেলাতেই যান না৷ শুরুই করেন তেলের বদলে পামওয়েল দেওয়া খাবার বিক্রি করতে৷ এতে দেশে কতজন তরুণ হৃদরোগের ঝুঁকিতে পড়ছেন, কিংবা গত এক বছরে ২০-৪০ বছর বয়সী লোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন সেই তথ্য আপনাদের না জানলেও চলবে৷ শুধু ব্যবসা করে অর্থ উপার্জনটিই গুরুত্বপূর্ণ৷
খাদ্যপণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটি জিনিসই অনুধাবন করেছি বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ- যে দেশে শিশুখাদ্যে সীসা, লৌহকনা, প্লাস্টিক, ইটের গুঁড়া, চকের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়৷ কোনো ব্যবসায়ী কখনোই চিন্তা করেননি তার বিক্রি করা খাবারটি তার সন্তানও খাবে, তার আত্মীয়-পরিজন সবাই খাবে৷ অবশ্য এইসব নীতি নৈতিকতার ধার ধারলে তো ব্যবসায়ীরা শীর্ষ ধনীদের তালিকায় থাকতে পারবেন না৷
বরং সামনে আসছে রমজান মাস৷ এই মাসে খাদ্য গ্রহণ ও ব্যয় যেকোনো সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ আগাম জানিয়ে রাখছি এই সময় চকবাজারের মতো ঐতিহ্যবাহী ইফতারের দোকানে- হাইড্রোজ দেওয়া মুচমুচে জিলাপি, স্যাকারিনে ডোবানো কুড়কুড়ে, ডায়িংয়ের রঙ দেওয়া শরবত ও কাবার টিকিয়া, ইউরিয়ায় ভাজা মুড়ি ও চিড়ায় বানানো বড় বাপের পোলায় খায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে৷ পাশাপাশি মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া ট্যাং, খেজুরসহ আরও অনেক পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে৷ ফ্রোজেন চিকেন, বিফ, মরা মুরগি বা কার্বাইড দেওয়া সব্জির আলাপে নাইবা গেলাম৷ রেস্তোরাঁগুলোতে সাজানো হবে নানাবিধ মুখরোচক খাবারের পসরা, পেঁয়াজু, বেগুনী চপের মতো খাবার দীর্ঘক্ষণ খাবার মুচমুচে রাখতে তেলের সঙ্গে মেশানো হবে ডিজেল বা মোবিল৷ ভোজ্য তেলের সঙ্গে ডিজেল বা মোবিল ব্যবহার করলে খাবার মুচমুচে থাকে এই আবিষ্কারককে একটি সম্মাননা দেওয়া সময়ের দাবি৷ সুতরাং ঢাকার প্রায় দুই লাখ রেস্তোরাঁর খাবার খেতে প্রস্তুত হয়ে যান আপনারা৷
সঙ্গে এও জানিয়ে রাখছি- গতবছর দেশে মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশ ঘটেছে হৃদরোগে৷ এর মধ্যে বায়ুদূষণ ও খাদ্যে ভেজাল অন্যতম কারণ৷ সরাসরি খাবার থেকে ক্রোমিয়ামের মতো ধাতু গ্রহণ করে ক্যান্সার রোগীর হার কতটা বেড়েছে সেই তথ্যটাও জেনে নেবেন প্লিজ৷ পাশাপাশি রেস্তোরাঁর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশটাতেও নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি সচেতন নাগরিকদের ও হালের ফুড ক্রিটিক, গবেষক ও ব্লগারদের৷ শুরুটা তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে৷