ফরমালিন: ভুল, সবই ভুল!
১৩ মে ২০১৯২০১৪ সালে যখন আমসহ আরো অনেক গ্রীষ্মকালীন ফলের ভরা মৌসুম, তখন ঢাকাসহ সারাদেশে চলা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন-বিরোধী অভিযানের কথা অনেকেই হয়তো ভোলেননি৷ ঢাকায় ওই অভিযান পরিচালনা করেছিল ঢাকা মট্রোপলিটন পুলিশ৷ যোগ দিয়েছিল মোবাইল কোর্টসহ সরকারের আরো অনেক সংস্থা৷ ঢাকার বাইরেও সারাদেশে একইভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়৷ শত শত মন আম বিনষ্ট করা হয়৷ বিনষ্ট করা হয় লিচু, তরমুজসহ আরো অনেক মৌসুমী ফল৷ মাছের বাজার আর শাক-সবজির কাঁচা বাজারেও চলে এই অভিযান৷ ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে ফলের ট্রাক থামিয়েও অভিযান চালানো হয়৷ আর ফরমালিন মাপার যন্ত্র দিয়ে তখন প্রায় সব ফলেই পাওয় যায় উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর ফরমালিন৷ লাখ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের৷ ফলের বাজার, মাছের বাজার শূন্য হয়ে যায়৷ পরের বছরও একইভাবে চলে অভিযান৷
২০১৩ সালে খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় বাংলাদেশে৷ একই সাথে খাদ্য সংরক্ষণে যে কোনো অননুমোদিত রাসায়নিক প্রয়োগের অপরাধে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে আইন তৈরি হয়৷ আর ২০১৫ সালে সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন করে এর ব্যবহার ও আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়৷
কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল৷ ফল-মূল এবং শাক-সবজি ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণ করা যায় না৷ আর সংরক্ষণের কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি, যা হয়েছে তা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘ফল মূল, শাক-সবজি এগুলো হলো ফাইবার৷ এখানে ফরমালিন দেয়ার কোনো সুযোগই নেই৷ কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না৷ সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না৷ কারণ, এখানে কোনো প্রোটিন নেই৷ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ধারণা যে, ফল-মূল, শাক-সবজিতে ফরমালিন দেয়া হয়৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমদানি করা আপেলে এক ধরনের এডিবল প্যারাফিন দেয়া হয়৷ এটা খাওয়ার যোগ্য৷ আমরা আপেল খাওয়ার পর এটা আবার একইভাবে বেরিয়ে আসবে৷ ফল-মূলে ৪০ ভাগ পানি থাকে৷ প্রতিদিন ওজন কমে ৫ থেকে ১০ গ্রাম৷ এখন একটি আপেলের প্রতিদিন যদি ৫ গ্রাম ওজন কমে তাহলে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল থেকে আপেল আসতে সময় লাগে ২১ দিন, আসতে আসতেই হাড্ডিসার হয়ে যাবে৷ কেউ কিনবে না৷ আপনি-আমি যে আপেল খাই, অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সেই একই আপেল খান৷ বিদেশে গেলে একটা আপেল, একটা মাল্টা নিয়ে আসবেন, দেড় বছরে কিছু হবে না৷ এটা হলো সায়েন্স৷ এটা এডিবল প্যারাফিন দিয়ে করা হয়৷ এখন ফলের খোসা দিয়ে কোটিং তৈরি করা হয়৷ আবার স্টিকার বের হয়েছে, যা ফলের ওপরে লাগানো থাকে, ওই রকম স্টিকার, যা দিয়ে আমের লাইফ দুই সপ্তাহ বাড়ানো যায়৷ এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷''
তবে ‘আগাম আম’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমের একটি ক্যালেন্ডার আছে৷ তাই ২০ থেকে ২৫ মে-র আগে আম খাওয়া ঠিক নয়৷ আগাম পেড়ে ফেলা আম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়৷ সরকারের উচিত হবে মার্চ-এপ্রিলে যে আম আমদানি হয়, তা বন্ধ করা৷ দুই মাস এলসি বন্ধ রাখা৷ কারণ, সেগুলো শতভাগ কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আঙুর নিয়েও আমাদের এখানে একটা ভুল ধারণা আছে৷ দেখবেন, আঙুরের ওপর সাদা সাদা পাউডার৷ অনেক মানুষই মনে করে এটা কীটনাশক৷ কিন্তু আসলে তা নয়৷ এটা এক ধরনের ন্যাচারাল কোটিং৷ এটা ওয়েট লস থেকে রক্ষা করে৷ পোকা -মাকড়ের আক্রমণ থেকেও রক্ষা করে৷''
তিনি জানান, ‘‘আমের মুকুল বা গুটি আমে যে কীটনাশক দেয়া হয়, তা এখন ১৫-২০ দিনের বেশি থাকে না৷ তাই আতঙ্কের কিছু নেই৷''
ফরমালিন টেস্টের পদ্ধতি এবং কীট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না৷ সেটা তখন বলায় বেনজীর আহমেদ (ডিএমপি'র তখনকার কমিশনার) আমাকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু আদালতের নির্দেশে অ্যামেরিকায় পরীক্ষা করে এখন প্রমাণ হয়েছে ওই কীটগুলো ঠিক ছিল না৷''
তিনি বলেন, ‘‘যে মাছ পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়, যেমন মলা, কাচকি মাছে এক সময় দশমিক তিন থেকে পাঁচ ভাগ ফরমালিন কেউ কেউ সময় সময় ব্যাবহার করতো৷ ফরমালিনের এমন ঝঁঝালো গন্ধ, যা বেশি ব্যবহার করা যায় না৷ এটা ধুয়ে ফেললে আর থাকে না৷ তবে এটা এখন আর দেয়াই হয় না৷''
তাঁর মতে , ‘‘আমরা আসলে ফরমালিন আতঙ্কে ভুগছি৷ এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে৷ আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে ফল-মূল, শাক সবজি৷ এখন আমরা আতঙ্কে তা খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছি৷ এটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ফরমালিন হলো হাইলি ভোল্যাটাইল এবং হাইলি সোলিবল৷ ভোল্যাটাইল মানে হলো উদ্বায়ী৷ একটি আম যদি ফরমালিনে চুবানো হয়, তাহলে আমটা তোলার পর দ্রুত ফরমালিন উড়ে যাবে৷ আর পানিতে দিলে খুব দ্রুত এটা দ্রবীভূত হয়ে যাবে৷ আসলে ফল-মূল, শাকসবজি সংরক্ষণে এর কোনো ভূমিকা নেই৷''
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘এখন দেশে ফরমালিনই নেই৷ সুতরাং ফরমালিন মেশানোর সুযোগও নেই৷ ২০১৫ সালে এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ফরমালিন ফল-মূল সংরক্ষণে কাজ করে কিনা৷ প্রোটিন বন্ডেজ ছাড়া সেলুলোজ বন্ডেজে ফরমালিন দিলেও কাজ করবে না৷ কাজেই কেউ যদি অতীতে শাক-সবজি, ফল-মূল সংরক্ষণে ফরমালিন দিয়েও থাকেন, তা কাজে আসেনি৷ আসবেও না৷''
তিনি জানান, ‘‘তবে এমনিতে ন্যাচারালি ফরমাল ডিহাইড থাকে৷ এটা সহজাত৷ প্রত্যেকটি ফলে সিজস্ব ফরমাল ডিহাইড ক্রিয়েট হয়, যা ফলকে পাকতে সহায়তা করে৷ নয়তো ফল পাকতো না৷ আর আমদানি করা ফল, যেমন আপেল সংরক্ষণের জন্য ওয়াক্স কোটিং দেয়া হয়৷ আমাদের যে ধারণা দেশি ফল-মূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা৷ এটা আমাদের একটা আতঙ্ক৷ আর এ কারণে আমরা জাতি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘মাছের ক্ষেত্রে কেউ যদি মাছ ফরমালিনে চুবিয়ে উঠিয়ে রাখে, তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবেই ফরমালিন কাজ করার কথা নয়৷ ২৪ ঘণ্টা ফরমালিনের মধ্যে চুবিয়ে রাখতে হবে৷ তাহলে বন্ডেজ ক্রিয়েট হবে৷ আর তীব্র ঝাঁঝালো ঘন্ধ থাকায় এটাকে ফরমালিনে ডুবালে লুকানো যায় না৷''
তাহলে এত যে অভিযান, এত ফল-মূল ধংস করা হলো, তা কি ভুল ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হয়ত আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি৷ ফরমালিন পরীক্ষার কিট হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা করে দেখা গেল আমাদের কিট ঠিক ছিল না৷ তবে সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ওই অভিযান হয়েছে৷ তাই সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু ফলে ন্যাচারালি ফরমাল ডিহাড তৈরি হয়, তাই স্বীকৃত মেশিন দিয়ে মাপলেও ফলে ফরমালিন পাওয়া যাবে৷ আমাদের জানতে হবে, ক্ষতিকারক মাত্রা কত৷ আবার এই ক্ষতিকারক মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করা নেই৷ এটা সর্বোচচ ১০০ পিপিএম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য৷''
বাংলাদেশে ফরমালিন আমদানি নিষিদ্ধ করার আগে শিল্পে ব্যবহারের জন্য এর আমদানীর অনুমতি দেয়া হতো৷ ওই সময়ে হয়তো বুঝে না বুঝে ফরমালিনের অপব্যবহার হয়ে থাকতে পারে৷ মাহবুব কবীর জানান, ‘‘২০১৪ সালে এক বছরে ফরমাল ডিহাইড পাউডার আমদানি হয়েছিল সাড়ে ১৭ হাজার মেট্রিক টন৷ এক কেজি পাউডারে ৪০ লিটার পানি দিলে সেটা ফরমালিন হবে৷ তাহলে ওই এক বছরে দেশে মোট ফরমালিন এসেছে ৬ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন৷ এত ফরমালিন কী কাজে লেগেছে সেটা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন আছে৷ তখন ফরমালিনের দামও কম ছিল৷ লিটার বিক্রি হতো ৮০-৯০ টাকায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘তখন হয়ত কেউ বুঝে-না-বুঝে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকতে পারেন৷ তবে তা কাজে আসেনি৷''