বাজেটের দিনই বাড়ল খেলাপি ঋণ
৮ জুন ২০২৪বাংলাদেশ ব্যাংক সবশেষ ত্রৈমাসিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ জানিয়েছে ৬ জুন বাজেট পেশের দিন। আর তাতে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিলএক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এটা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১.১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, "ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি খেলাপি হওয়া সুদ যুক্ত হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।”
ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মার্চে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে আট হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৭৩ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২০. ৯৯ শতাংশ খেলাপি ছিল। মার্চে বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক- বিশেষায়িত এই দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের হার ১৩.৮৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৮৮ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর ৫.৯৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি ছিল। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৭.২৪ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। মার্চে বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ডিসেম্বরে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪.৮২ শতাংশ ঋণখেলাপি ছিল। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৫.২ শতাংশ।
কোনো ব্যাংকই খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো বেশি:
তবেবাংলাদেশ ব্যাংক খেলপি ঋণের যে হিসাবদেয় তা প্রকৃত হিসাব নয়। তারা অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা খেলপি ঋণের হিসাব প্রকাশ করেনা।সেই হিসাব ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ কোটি টাকার মধ্যে। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকাশ করেনা। তারা এটাকে আইনের নানা প্যাঁচে চাপিয়ে রাখে। তার কথা," আড়াই লাখ কোটি টাকা অর্থঋণ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে মামলার কারণে আটকে আছে। ৬৬ হাজার কোটি টাকা রাইট অফ ( যে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা নাই) করা হয়েছে। ওই ঋণের হিসাব ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই দুইটি ক্যাটাগরি যোগ করলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাংক তা হিসাবে দেখায়না।”
আর পলিসি রিচার্স সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন," বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সব খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকাশ করা। কারণ ওটাতো আমানতকারীদের টাকা। কারা এগুলো নিয়েছে তাও প্রকাশ করা দরকার। ব্যাংকগুলোর যে এখন আর্থিক দুরবস্থা তার অন্যতম কারণ এই খেলাপি ঋণ।”
খেলাপিদের পৌষ মাস সাধারণের সর্বনাশ:
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই ঋণ এখন ৯ গুণ বেড়েছে। আর প্রকৃত খেলাপি ঋণের হিসাব ধরলে এটা আরো কয়েকগুণ বেশি হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের নানা সুবিধা দিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিলো খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। উল্টো খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বেড়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর ঋণ খেলাপির সংজ্ঞা শিথিল করে দেয়। তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য বাড়তি তিন মাস সময় পায়, ঋণ খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটানোর সুযোগ পায়। ২০১৯ সালে ঋণের দুই শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। আর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আবার আড়াই থেকে ছয় শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এর জন্য প্রচলিত সুবিধা হলো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়, যা আগে ছিলো দুই বছর। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ওই সুযোগ নিয়ে তারা আরো ঋণ নিয়েছেন। নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। নানা সুবিধা নিয়েছেন। উল্টো বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
২০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা প্রকৃত খেলাপি ঋণের চেয়ে কম। আবার বাজেটে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। যা ঘোষিত খেলাপি ঋণের সমান। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন," একদিকে সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের চাপও বাড়ছে। এটাকে কোনোভাবেই আর্থিক খাতে সুনশান বলা যায়না।খেলাপি ঋণ সমস্যার সামাধান হলেই অর্থনীতির অনেক সংকট কেটে যাবে।”
কী হবে খেলাপি ঋণের ?
খেলাপি ঋণ নিয়ে বিভিন্ন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার তার বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক খাতের সংস্কার অব্যাহত রাখার কথা বললেও খেলাপি ঋণ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। আর তার বাজেট বক্তৃতার সময়ই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে শুক্রবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে খেলাপি ঋণের অব্যাহত বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণের সমস্যা এক দিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরেই নানা কারণে হয়েছে। সরকারের অন্যতম টার্গেট খেলাপি ঋণ কমানো।''
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন," এই খেলাপি ঋণের সিংহভাগই একটি গোষ্ঠীর। ঘুরেফিরে তারাই ঋণ নিচ্ছে। তারাই খেলাপি হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। ব্যবস্থা নিলে তো এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।”
তার কথায়,"এরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। আর অর্থনীতি ব্যক্তি তুষ্টির ওপর চলে গেছে। ফলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায় হলেই ব্যাংক খাত সবল হবে।”
আর অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের কথা," আসলে খেলাপি ঋণ আদায় হবেনা। কারণ সরকারতো ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। প্রত্যেক ব্যাংকের যে রাঘব বোয়াল ঋণ খেলাপি তাদের যদি ট্রাইব্যুনাল করে শাস্তির মুখোমুখি করা না যায় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবেনা।”
তার কথায়," ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার মোটেই আন্তরিক নয়। কারণ তারা অনেকেই সরবকারের কাছের লোক।”