শিক্ষক নির্যাতন এবং নির্যাতিতদের টিকে থাকার সংগ্রাম
১ জুলাই ২০২২সম্প্রতি নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে৷ স্বপন কুমার বিশ্বাস এখনো এলাকায় ফিরতে পারেননি৷ ঢাকার আশুলিয়ায় আরেক ঘটনায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার এক ছাত্রের অতর্কিত হামলায় আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান৷
স্বপন কুমার বিশ্বাস ফিরলেও কি সমাজে একজন শিক্ষকের যে সম্মান, মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপন করার কথা, সেই জীবন ফিরে পাবেন? অতীত সেই ভরসা দিচ্ছে কই!
নারায়নগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত, মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মন্ডল বা বাগেরহাটের কৃষ্ণপদ মহলী ও অশোক কুমার ঘোষালসহ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল এখনো তারা দুঃসময়ই পার করছেন৷ কেউ কম, কেউ বেশি৷ এখনও হুমকি-ধামকি চলছে৷ কেউ কেউ তো দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও ভাবছেন!
গত ১৮ জুন শিক্ষক নির্যাতনের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায়ের কথিত এক এক ফেসবুক পোস্ট নিয়ে৷ সেই পোস্টের কারণেই তোলা হয় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ৷ এর জেরেই গুজব ছড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয় জুতার মালা৷ সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়৷
গত ২৫ জুন দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটায় একই প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থী৷ পরে শিক্ষককে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান৷ এ নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হলে পুলিশ শিক্ষার্থী ও তার বাবাকে গ্রেপ্তার করে৷
এই দুই ঘটনার কিছুদিন আগে, গত ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননা করেছেন- এমন অভিযোগ আনা হয়৷ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে৷ দেশজুড়ে এর প্রতিবাদ হয়৷ ১৯ দিন করাভোগের পর জামিন পান তিনি৷ তারপর আবার স্কুলে যোগাদান করেছেন৷ তবে এখনো আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন, দেওয়া হচ্ছে হুমকি-ধামকিও৷
এভাবে কি বেঁচে থাকা যায় : হৃদয় মন্ডল
ডয়চে ভেলেকে হৃদয় মন্ডল বলেছেন, ‘‘মামলা এখনো চলছে৷ এখনো বাড়ির গেটে রাতের বেলায় কে বা কারা এসে ধাক্কাধাক্কি করে৷ হৃদয় মন্ডলের চামড়া তুলে নেওয়ার কথাও বলে৷ ফোন করে বলে, তোর একটা মেয়ে আছে না? এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়৷ তাই ভাবছি মামলাটি খারিজ হয়ে গেলে বিদেশের কোনো দূতাবাসে দাঁড়াবো৷ দেশে থাকলে ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না৷ স্কুল আর স্কুলের গেটেই বাড়ির মধ্যে আটকে গেছে জীবন৷ শিক্ষক নির্যাতনের এই ঘটনাগুলোয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়৷’’
২০১৬ সালে বাগেরহাটের চিতলমারীতে ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ তোলা হয় একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে৷ তবে হামলা হয় সেই শিক্ষক ও প্রধানশিক্ষকসহ দু'জনের ওপর৷ দু‘জন শিক্ষককেই ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ শিক্ষক দু'জন হলেন, চিতলমারীর হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী ও বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল৷ অভিযোগ অনুযায়ী, স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল ধর্ম সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তোলে৷ অভিযোগটি প্রধান শিক্ষককে জানায়৷ পরে প্রধান শিক্ষক বিজ্ঞান শিক্ষকের পক্ষ নিয়েছেন- এমন অভিযোগ তোলা হয়৷ পরেরদিন, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল স্কুলে হামলা চালানো হয়৷ দুই শিক্ষককে আটকে রাখা হয় লাইব্রেরি কক্ষে৷ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজসহ প্রশাসনের লোকজন গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন৷ পরে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ছয় মাসের জেল দেন আনোয়ার পারভেজ৷
তারা এখন ম্যানেজিং কমিটিতে, ফলে এখন টিকে থাকাই মুশকিল : কৃষ্ণপদ মহলী
এখন কেমন আছেন- জানতে চাইলে কৃষ্ণপদ মহলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খুবই আতঙ্কে আছি৷ কষ্টে আছি৷ ওরা এখনো হুমকি-ধামকি দেয়৷ অশোক কুমার গত বছর স্বাভাবিকভাবে অবসরে গেছেন৷ ওই ঘটনার পর আদালত অশোক বাবুকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে স্কুলে যোগ দেওয়া সুযোগ দেয়৷ আমাকে আগেই মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে৷ যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছিল, তারা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল৷ এখন তারা আবার জিতেছে৷ ফলে আমার পক্ষে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে৷”
২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সামনে কান ধরে উঠবস করতে দেখা যায়৷ ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষকের এমন অবমাননার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশের অনেক মানুষ৷ এক পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ সেই তদন্তে শ্যামল কান্তি ভক্ত নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আবার পদে পুনর্বহাল করা হয়৷
এরপর সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন শ্যামল কান্তি ভক্ত৷ সেই মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছে৷ পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বয়স পূর্ণ হওয়ার পর তিনি অবসরে যান বলে ডয়চে ভেলেকে জানান৷ বর্তমানে মেয়ের সঙ্গে ঢাকাতেই থাকেন শ্যামল কান্তি ভক্ত৷ নিজের বর্তমান অবস্থার কথা বলতেও কেমন যেন ভয় পাচ্ছিলেন তিনি!
এখন শিক্ষার দাম নেই, শিক্ষকেরও দাম নেই : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলাদেশে শিক্ষক নির্যাতনের এই ধারা কি সাম্প্রতিক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন শিক্ষার দাম নেই, তাই শিক্ষকদেরও দাম নেই৷ এখন অর্থ আর ক্ষমতাবানদের সময়৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমনই হয়৷ এটা একদিনে হয়নি৷ আমাদের অবক্ষয় ক্রমেই নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, গত ১০ বছরে শিক্ষকদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে৷ বেশি নির্যাতিত হয়েছেন সংখ্যালঘু শিক্ষকরা৷ দীর্ঘদিন শিক্ষা বিষয়ে কাজ করেছেন সাংবাদিক শরিফুজ্জামান পিন্টু৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আগেও শিক্ষক নির্যাতন ছিল, কিন্তু সেটা এখনকার মতো না৷ খুব অল্প সময়ে শিক্ষকদের নির্যাতনের নতুন মাত্রা পেয়েছে৷ সামাজিক অবক্ষয় এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷’’
গত বুধবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে৷ গত ২৯ মে লক্ষীপুর সদর উপজেলায় একজন শিক্ষকের ওপর হামলা চালায় সাবেক এক ছাত্র৷ শিক্ষকের ‘অপরাধ’ ৫ বছর আগে পরীক্ষায় নকলে ছাত্রকে বাধা দিয়েছিলেন তিনি৷ দীর্ঘদিন সেই ক্ষোভ পুষে রেখে ২৯ মে শিক্ষকের উপর হামলা করে সেই ছাত্র৷ ২০১৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর বিয়ে বন্ধ করায় তরিকুল ইসলাম নামে নোয়াখালীর এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে মেয়েটির পরিবার৷ ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে আমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুলতান আহম্মেদ ও সহকারী শিক্ষক সজল দাশের উপর হামলা চালানো হয়৷ অভিযোগের আঙুল ওঠে জামায়াত শিবির কর্মীদের দিকে৷ গত ১০ বছরে এমন অসংখ্য শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু হামলাকারীদের বিচার হয়েছে এমন নজির খুবই কম৷
শিক্ষক নির্যাতনের এই ঘটনাগুলোর পর শিক্ষক নেতাদের খুব একটা সক্রিয়তা দেখা যায়নি৷ তবে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম সাজু দাবি করেন, ‘‘আমরা সব সময় নির্যাতিত শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াই৷ সবগুলো ঘটনাতেই আমরা প্রথম নির্যাতিত শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়েছি৷’’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগপন্থি আর বিএনপিপন্থি দুই ভাগে বিভক্ত৷ ফলে কারা নির্যাতন করেছে সেটা দেখেই তারা সিদ্ধান্ত নেন ওই ঘটনার প্রতিবাদ করবেন কিনা৷
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষকদের এই আক্রান্ত হওয়ার জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী৷ রাষ্ট্রের যেমন দায় আছে, আমাদেরও দায় আছে৷ আমরা শিক্ষকদের সম্মান দিচ্ছি না, যেটা নতুন প্রজন্ম দেখছে৷ তারাও সেটা শিখছে৷ আগে রাষ্ট্রকে শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে৷ তাহলে এই ধরনের নির্যাতন দিন দিন কমে আসবে৷ আবার যারা নির্যাতন করছেন তারাও ক্ষমতাধর হওয়ায় কোনো বিচার হচ্ছে না৷ ফলে নির্যাতনের পরিমানটা বেড়েই চলেছে৷”