বাংলাদেশে জঙ্গি গুরুর ফাঁসি
১২ এপ্রিল ২০১৭১৩ বছর আগে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় বুধবার রাত ১০টায় ঢাকার অদূরে কাসিমপুর কারাগারে মুফতি হান্নান এবং ও শরিফ শাহেদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়৷ প্রায় একই সময়ে রাত ১০টা ১ মিনিটে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয় হুজি সদস্য দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি৷ কাসিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান এবং সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সগীর মিয়া আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং-এ সংবাদমাধ্যমকে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার তথ্য জানান৷ আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন আহমেদও সংবাদমাধ্যমকে একই সময়ে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা ঘোষণা করেন৷
২০০৪ সালের ২১শে মে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেট হজরত শাহজালাল (রহ.)-মাজরের হামলা হয়৷ ঐ দিন মাজারের মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে বের হওয়ার পর সেই হামলার ঘটনা ঘটে৷ হামলায় তিনজন নিহত হন৷ গুরুতর আহত হন আনোয়ার চৌধুরীসহ ৭০ জন৷ এই মামলায় ২০০৮ সালের ২৩শে ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, হুজির সদস্য শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপন মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়৷ অন্য দুই আসামি মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি ও মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত৷ এরপর হাইকোর্ট এবং আপীল বিভাগেও মুফতি হান্নানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল থাকে৷ আপিল বিভাগের রায়ের পর রিভিউ আবেদনও করা হয়েছিল৷ কিন্তু গত ২২শে মার্চ সেই রিভিউ আদেশেও মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়৷ এমনকি রাষ্ট্রপতির কাছে তার প্রাণভিক্ষার আবেদনও নাকোচ হয় ৮ই এপ্রিল৷
২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেরমনার বটমূলে হামলার ঘটনাতেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় মুফতি হান্নানকে৷ তবে রমনা বটমূলের মামলার এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় আনোয়ার চৌধুরীর মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর করা হলো৷
মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে যত মামলা
এ দু'টি মামলা ছাড়াও আরও ১৫টি জঙ্গি হামলার মামলা ছিল হান্নানের বিরুদ্ধে৷ এর মধ্যে ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থলের কাছে বোমা রেখে তাকে হত্যার চেষ্টাও ছিল৷ এরপর ঘটে ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা৷ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ-এর সমাবেশে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার টার্গেট ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা সেই সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা৷ শেখ হাসিনা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান৷ কিন্তু ঐ হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন৷ ২০০৫ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিল এই মুফতি হান্নান৷
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুকে আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে আরো মামলা থাকলেও, তার ফাঁসি কার্যকরে কোনো বাধা ছিল না৷ কারণ এই মামলার চূড়ান্ত রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ দণ্ড৷ সর্বোচ্চ দণ্ড কার্যকর করাই নিয়ম৷''
হরকাতুল জিহাদের প্রতিষ্ঠাতা
মুফতি হান্নান ছিল বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) প্রতিষ্ঠাতা৷ তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামে৷ সে একজন আফগানিস্তান থেকে ফেরত আসা ‘মুজাহিদ'৷ আফগানিস্তানে বসেই মুফতি হান্নান এবং তার অনুসারীরা হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ গঠন করে৷ নব্বইয়ের দশকে তারা বাংলাদেশে তৎপরতা শুরু করে৷ ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থলের কাছে বোমা রেখে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনার ঘটনায় মুফতি হান্নানের নাম প্রথম আলোচনায় আসে৷
মুফতি হান্নানের ফাঁসি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ আফগানিস্তান ফেরৎ মুজাহিদ হিসেবে সে-ই প্রথম বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ প্রতিষ্ঠা করে জঙ্গিবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়৷ তবে সে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিল৷ তাই অনেক হামলার সঙ্গে সে জড়িত থাকলেও, তাকে প্রথমদিকে আটক বা বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি৷ কেউ কেউ ধারণা করেছিল, মুফতি হান্নান ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘মুফতি হান্নান অনেক জঙ্গি এবং জঙ্গি গ্রুপের ‘আইডল' ছিল৷ তাই তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে তাদের কাছে একটা বার্তা যাবে৷ তারা বুঝতে পারবে যে, ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করে শেষ পর্যন্ত রেহাই পাওয়া যায় না৷''
১০ জঙ্গির ফাঁসি
আরেক জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) দুই নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের ফাঁসির পর, বাংলাদেশে কোনো শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলো৷ অর্থাৎ বুধবার রাতে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ জন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হলো বাংলাদেশে৷
২০০৫ সালে ঝালকাঠিতে বোমা হামলা চালিয়ে দুই বিচারক হত্যার মামলায় ২০০৭ সালের ২৯শে মার্চ জেএমবি-র শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, আব্দুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুকের ফাঁসি কার্যকর হয়৷ ঐ একই মামলায় পলাতক জেএমবি জঙ্গি আরিফ পরে আটক হলে, তার ফাঁসি কর্যকর হয় গত বছরের ১৬ই অক্টোবর৷