চলতি বছরের শুরুতে ঢাকায় একটি সংবাদমাধ্যমের কর্মী বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ই-ঋণ (অনলাইন) নেয়। ফেব্রুয়ারিতে নেওয়া এই ঋণ তাকে ছয় মাসের মধ্যে সুদসহ আগস্টে পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রতিমাসে তার বেতন থেকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৫ হাজার ৫৫১ টাকা একটি নিদির্ষ্ট তারিখের মধ্যে কেটে নিয়েছে। সেই তারিখের মধ্যে কখনো তার অ্যাকাউন্টে বেতন না ঢুকলে জরিমানসহ তাকে সেই টাকা শোধ করতে হয়েছে। তবে এই ঋণ-পদ্ধতি নিম্ন মধ্যবিত্ত গণমাধ্যমকর্মীকে হুট করে ঘটা তার অর্থনৈতিক মন্দাতে সাহায্য করেছিল। আর সেই ধারাবাহিকতায় তিনি বছরের শেষদিকে এসে আরো একটি ঋণের আবেদন করেন।
উপরের এই ঘটনা পড়লে স্বভাবতই মনে হতে পারে বাংলাদেশে ঋণদাতা ও গ্রহীতা হয়ত এমন চরিত্রেরই হয়ে থাকে। তবে দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণ নেওয়া ও শোধ করার সামগ্রিক চিত্র নিম্ন মধ্যবিত্ত ওই সংবাদকর্মীর মতো নয়। দেশের বর্তমান ঋণ বাস্তবতার প্রেক্ষাপট এই লেখায় একটু ভিন্নভাবে আলোচনা করবো। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ নেওয়া ও তা শোধ না করে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার অনেকগুলো সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একটি মধ্যম আয়ের দেশে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ হিসেবে নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী আর পরিশোধ করেননি।
সাধারণত ঋণ হলো এমন একটি আর্থিক সুবিধা, যা একটি ব্যক্তি বা সংস্থা অন্য ব্যক্তির থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার হিসেবে গ্রহণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট সুদের হারে তা পরিশোধ করে। এটি সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন, ব্যাংক বা আর্থিক সংস্থাগুলি প্রদান করে। ঋণ নিতে হলে সাধারণত কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় এবং সেই ঋণের উপর নির্দিষ্ট সুদের হার প্রযোজ্য হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঋণগ্রহীতা প্রথমে ঋণের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে এবং প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ ঠিক করে। এরপর ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটি ঋণের অনুমোদন ও সুদের হারে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের ঋণ সুবিধা থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-ব্যক্তিগত ঋণ, ব্যবসায়িক ঋণ, গৃহঋণ। ঋণ পাওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট দলিলাদি যেমন পরিচয়পত্র, আয়ের প্রমাণপত্র, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ঠিকানার প্রমাণ ইত্যাদি ব্যাংকে জমা দিতে হয়। ব্যবসায়িক ঋণের জন্য ব্যবসার কাগজপত্র ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা দিতে হয়। ঋণ নিতে হলে ব্যাংকের ব্রাঞ্চে গিয়ে আবেদন ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হয়। আবার অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করার সুবিধা থাকে। এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণগ্রহীতার কাগজপত্র যাচাই করে এবং প্রয়োজন হলে সাক্ষাৎকার নেয়। ব্যাংক সব কিছু যাচাই-বাছাই করে ঋণের জন্য অনুমোদন প্রদান করে। ঋণ গ্রহণের পর মাসিক কিস্তির ভিত্তিতে বা ব্যাংকের নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিশোধ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, যাতে অতিরিক্ত জরিমানা না দিতে হয়।
ঋণ দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়গুলো বাংলাদেশে খুবই সাধারণ বিষয়। তবে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে লেখার শুরুর নিম্নমধ্যবিত্ত সংবাদকর্মীর মতো অবস্থা ছিল না। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে, দেশে কখনোই নির্দিষ্টভাবে ঋণ খেলাপির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণত ব্যাংকগুলো ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে না এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করে না। বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনে এসব কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে।
দেশে খেলাপি ঋণ পরিশোধ না হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং তা অর্থনীতিতে অর্থ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে।খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও অব্যবস্থাপনার কারণেঅনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে তারা যথাযথভাবে ঋণ বিতরণ ও সাধারণ গ্রাহকের প্রয়োজনীয় ঋণ চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং সাধারণ জনগণের জন্য
অর্থের সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের এই দুর্বলতা প্রভাব ফেলছে সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তার ওপর, যার ফলে জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেও ব্যাংকের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্কের কারণে তারা নিয়মিত ঋণ পুনঃতফসিল ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। এই ধরনের প্রভাবের কারণে ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে এবং সাধারণ ঋণগ্রহীতারা প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট প্রথম আলোর একটি সংবাদে দেশের ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা বোঝাতে লিখেছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘নখদন্তহীন' অবস্থায় রয়েছে। জোর করে মালিকানা দখল করা ব্যাংকগুলো খালি করে ফেলেছেন নতুন মালিকেরা। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো জামানত ছাড়া ছাপানো টাকা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে ছয়-সাতটি ব্যাংক। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত থেকে ডলারে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। নথিপত্রে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দুই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বলে মনে করা হয়।
এবার আসি আর একটি ঘটনায়। গত দুইমাসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মকর্তা ব্যাংকে গিয়ে তার বেতনের টাকা তুলতে পারেননি। কারণ, ব্যাংকে টাকা নেই। এক ফেসবুক পোষ্টে তিনি সেই কথা কয়েকবার লিখেছেন। তিনি লেখেন, ‘‘আমরা দেখছি, গ্রাহকরা লাইন ধরে ধরে ৫-১০ হাজার টাকাই কেবল তুলতে পারছে স্বাভাবিকভাবে। হাতে-পায়ে ধরলে ২০ হাজার। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী সিনারিওটা বড়লোক গ্রাহকের জন্য এক না। বড় অ্যামাউন্ট ও ট্র্যান্সফার হচ্ছে। স্পেশাল গ্রাহক এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এর জন্য স্পেশাল ট্রিটমেন্টের কথা আগেই উল্লেখ করেছিলাম। কিন্ত এই স্পেশাল ট্রিটমেন্ট আসলেই কত বড় অ্যামাউন্টের হতে পারে ভেবে দেখেছেন?'
আরেকটি পোস্টে তিনি লেখন, রাজধানীর দিলকুশা ব্রাঞ্চ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কিছু গ্রাহক ৫০ হাজার থেকে এক লাখ (কখনো আরো বেশি) পাচ্ছে। আর কিছু ব্রাঞ্চের গ্রাহক টাকাই পাচ্ছে না, বড়জোর ৫ হাজার টাকা। এখন সব গ্রাহক কি দিলকুশা গিয়ে ভীড় করবে? যদি দিলকুশাই একমাত্র গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দিতে পারে, তাহলে অন্য ব্রাঞ্চ চালু রেখে বিদ্যুৎ, এসির ব্যয় করছে কেন? গ্রাহকদের ভোগান্তি করাচ্ছে কেন? হয়ত এখন দেশে থাকলে একই অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হতে হতো। এই গেল দেশের সামগ্রিক বর্তমান অবস্থায়। এবার আসি জার্মানির প্রেক্ষাপটে।
জার্মানিতে বেশিরভাগ মানুষ ক্যাশলেস থাকে। সবকিছুই কার্ডে বা অনলাইনে পে করে। এই সুবিধা বাংলাদেশে খুবই সীমিত। সেখানেও টাকা পাচার বা অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বলে সুবিধা দেওয়া হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত স্বচ্ছ ও শক্তিশালী। জার্মানিও এর ব্যতিক্রম নয়। ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সঠিক তথ্য যাচাই করার উপর বেশি জোর দেয়া হয়, যার ফলে ঋণ খেলাপির সংখ্যা কম এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমিত থাকে।
জার্মানির ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বেশ কম থাকে, যা ঋণগ্রহীতাদের জন্য লাভজনক। নিম্ন সুদের হার তাদের মাসিক কিস্তি সহজে পরিশোধ করতে সাহায্য করে এবং ঋণ পরিশোধের চাপে ফেলা থেকে বিরত রাখে। জার্মানির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাংক ঋণের স্থিতিশীল ও সামগ্রিকভাবে সাশ্রয়ী মডেল, যা ক্রমাগত আপডেট এবং পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। বাংলাদেশে ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং প্রভাবশালী খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা বন্ধ করতে জার্মানির মতো মডেল অনুসরণ করা প্রয়োজন, যা অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি আনতে সহায়ক হতে পারে।