ব্যাংকিং বিষয়টা বেশ জটিল। অন্য অনেকের মতো আমি নিজেও এ বিষয়টা তেমন ভালো বুঝি না। তবে এই জায়গায় মন্দ কিছু ঘটলে তার প্রভাবটা কিন্তু দেশের অতি সাধারণ মানুষও টের পায়।
আগের হাসিনা সরকারের শেষদিকে ডলার নিয়ে রীতিমতো হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকগুলো ডলার দিতে পারছিল না। বিদেশ থেকে কিছু কিনতে গেলে ডলার লাগে। সেই কেনাকাটা যেন থমকে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা হইচই করছিল। একবার দেখলাম এক অনুষ্ঠানে খোদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে প্রশ্ন করছেন। তারা মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইছেন—ছোট ব্যবসায়ীরা আমদানি কেন করতে পারছে না? এলসি কেন খুলতে পারছে না? এ নিয়ে সেই অনুষ্ঠানেই তখন বিরাট হইচই। মন্ত্রী ও তার সহচরদের কাছে জবাব ছিল না। তারা মিনমিন করে বলার চেষ্টা করছিলেন—যেভাবে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে পরিস্থিতি আসলে ততটা নাজুক নয়। ডলারের একটু টানাটানি যাচ্ছে, তবে সেটা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে।
ওই অনুষ্ঠানটির পর আরও কয়েক মাস টিকে ছিল হাসিনা সরকার। কিন্তু সমস্যা কেটে যায়নি। বরং আরও নাজুক হয়েছে। সে সময়ে আমার পরিচিত এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী খুব দুঃখ করছিলেন পরিস্থিতি নিয়ে। বলছিলেন, ব্যাংকে তার পর্যাপ্ত টাকা আছে। কিন্তু তার বিপরীতে ফ্যাক্টরির কিছু মেশিনারি আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছিলেন না। ব্যাংক ডলার দিতে পারছিল না। তিনি বলছিলেন, এই মেশিনারিগুলো আনতে না পারলে যে কোন সময় তার ফ্যাক্টরি বসে যেতে পারে। এতে উৎপাদন যেমন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমন শ্রমিকদেরও বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হবে না। টেনশনে তার রীতিমতো মাথা-খারাপ অবস্থা।
আমার সেই পরিচিত ব্যবসায়ী ভদ্রলোক তখন আরো একটা তথ্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—এই যে সংকট, এটা কিন্তু মূলত ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্যই বেশি। বড় বড় শিল্প গ্রুপকে এমন ঝামেলায় পড়তে হয় না, কারণ, তাদের নিজেদেরই ব্যাংক রয়েছে। সামান্য যা কিছু ডলার রয়েছে, সেসব তারা রেখে দিয়েছে নিজেদের জন্য। যে ব্যাংক ‘ডলার নেই' বলে আমাকে ফেরত দিচ্ছে, তারাই আবার তাদের মালিকদের প্রতিষ্ঠানকে এলসি খুলে দিচ্ছে।
কেবল আমদানি বাণিজ্যই নয়, ডলারের অভাবে খোদ সরকারকেও পড়তে হয়েছে বিপাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা প্রয়োজনে সরকারকে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়। আবার ভারতের আদানীর কাছ থেকে বিদ্যুৎও আমদানি করতে হয়। আসলে জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, ইত্যাদি পেট্রোলিয়ম পণ্যের আমদানি বাবদ আমাদের বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই সব ব্যয়ই পরিশোধ করতে হয় ডলারে। ডলারের অভাবে ব্যয় পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। ফলে তাদের কাছে বকেয়া পড়ে যাচ্ছিল। এভাবে বাড়তে বাড়তে বকেয়ার পরিমাণ সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অনেকে হুমকি দিচ্ছিল বকেয়া পরিশোধ না করলে কয়লা অথবা গ্যাস আর দেবে না। এরকম পরিস্থিতিতেই সরকার পরিবর্তন হয়।
ফলে ইউনূস সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন এই সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের বকেয়া তাদের ঘাড়ে। আগের সরকারের আমলে এই বকেয়া কীভাবে পরিশোধ করা হবে—তা নিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম ছিল সংশ্লিষ্টরা। তারা বুঝতে পারছিল না, ডলারগুলো আসবে কোথা থেকে।
এমনিতে আমরা ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা পেয়ে থাকি মোটের ওপর দুটি সোর্স থেকে। প্রথমত রপ্তানি আয় থেকে, এবং দ্বিতীয়ত বিদেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। রপ্তানির মধ্যে সিংহভাগই হচ্ছে পোশাক শিল্প। আবার পোশাক শিল্পের অনেকটাই নির্ভর করে আমদানির ওপর। আপনি যদি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি না করতে পারেন, তাহলে রপ্তানির জন্য ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপাদন করবেন কী করে? এ এক জটিল চক্র। কাজেই ডলারের ওই সংকটের সময় রপ্তানি বাণিজ্যেও বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল।
পাশাপাশি, রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল এক ধরনের বিচিত্র নেতিবাচক প্রবণতা। হাসিনা সরকারের প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশিদের অশ্রদ্ধা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তারা রেমিট্যান্স পাঠানো এক রকম বন্ধই করে দিয়েছিল। এদেশ থেকেও নানাবিধ প্রচারণা চলছিল। বলা হচ্ছিল, রেমিট্যান্স পাঠানো না হলে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যাবে। অনেকে আবার রেমিট্যান্স পাঠালেও সেটা পাঠাতো অবৈধ পথে, অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে সেটা আর সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার জাতীয় আয়ের সঙ্গে যুক্ত হতো না।
আয়ের পথগুলো সংকীর্ণ হওয়ার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার পাচার চলছিল অবাধে। বিদেশ অর্থ পাচারের এই অনৈতিক প্রতিযোগিতায় সরকার সংশ্লিষ্টরা সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। সরকার দেখেও ভান করছিল না দেখার। এ নিয়ে মিডিয়াগুলো হঠাৎ হঠাৎ সরব হলেও, তার কোনো প্রতিকার হচ্ছিল না। সরকার তার অনুগত বিচারবিভাগের মাধ্যমে বলতে গেলে ওই পাচারকারীদের এক রকম প্রটেকশনই দিত।
এভাবে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়া, আর উল্টোদিকে যতটুকু যা আছে সেটাও অবাধে বাইরে চলে যাওয়া —এই দুইয়ের প্রভাবে প্রতিদিনই কমছিল সরকারের রিজার্ভ। এই জটিল আবর্ত থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, কিংবা আদৌও সম্ভব কি-না, এরকম বিশাল এক প্রশ্নকে দাঁড় করিয়ে রেখেই কিন্তু পালিয়ে যায় সাবেক সরকারপ্রধান হাসিনা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূসের সরকারের যে কাজটি সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে সেটা হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা। দিন কয়েক বিলম্বে হলেও ড. আহসান এইচ মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই দ্রুত গতিতে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হতে থাকে। প্রথমেই তিনি ডাকাতদের হাত থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নেন। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ঋণ খেলাপিদের ধরার চেষ্টা করেন। সেই নতুনভাবে যাতে অর্থ আর পাচার না হতে পারে সে বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। কাজগুলো তিনি এতটাই দ্রুত বেগে এবং দৃশ্যমান ভাবে করেন যে, সেসব দেখে মানুষের মনে এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়। আর সবাই জানেন—পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমটাই আসলে দাঁড়িয়ে আছে এই আস্থার ওপর।
ক্রমবর্ধমান আস্থার কারণে প্রবাসীদের মনোভাবেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। রেমিট্যান্স আসতে থাকে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি করে প্রবাসীরা পাঠাতে থাকেন বৈদেশিক মুদ্রা। আর এই অর্থের প্রায় সবটাই আসে বৈধ পথে। হুন্ডি কমে যায়। আগে যে হুন্ডি ব্যবসায়ের একটা রমরমা ভাব ছিল, সেসব পরিচালিত হতো ওই চিহ্নিত অর্থপাচারকারীদের
ছত্রছায়াতেই। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা তো এরই মধ্যে পালিয়েছে। তাই হুন্ডি ব্যবসায়েও এক ধরনের ভাটা পড়ে যায়। ফলে যা কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আসছে এখন এর সিংহভাগই আসছে বৈধ পথে। পুরোটাই যুক্ত হচ্ছে আমাদের জাতীয় আয়ে।
আগে বিদেশি ঋণ বা বকেয়া পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে হাত দিতে হতো। ফলে রিজার্ভ কমতে কমতে একটা বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে এসেছিল। নতুন গভর্নর রিজার্ভে হাত দেওয়া থামিয়েছেন। বরং তিনি বকেয়া পরিশোধে নিয়েছেন আন্তঃব্যাংক ডলার বিনিময় পদ্ধতি। ব্যাংকগুলো নিজেরা নিজেরা ডলার কেনা-বেচা করে সমস্যা সমাধান করছে।
বিষয়টা এরকম, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স যেটা আসে, সেটা তো কোন না কোন ব্যাংকের মাধ্যমেই আসে। ধরা যাক, ইসলামি ব্যাংক বা সোনালী ব্যাংকে প্রচুর রেমিট্যান্স এসেছে। এতে এই দুই ব্যাংকে তাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ডলার আছে। এখন অন্য কোন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ত বেশি কিছু আমদানি করা হয়েছে, কিন্তু মূল্য পরিশোধ না করায় বকেয়া হয়ে আছে। বকেয়া পরিশোধ করার জন্য তাদের ডলার দরকার। সেই ডলারের জন্য যখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছে ইসলামি ব্যাংক অথবা সোনালী ব্যাংক থেকে ডলার কেনার। তারা সেখান থেকে ডলার কিনে বকেয়া পরিশোধ করছে। এভাবে বকেয়া যেমন পরিশোধ হচ্ছে, তেমনি নতুন এলসিও খোলার ক্ষেত্রেও আগের সেই জটিলতা আর থাকছে না।
এভাবে গত দুই মাসে খুবই চমৎকার এবং উল্লেখ করার মতো একটা অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। আগের সরকারের আমলে সেই যে বকেয়ার পরিমাণ সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়ে গিয়েছিল, তা থেকে প্রায় পৌনে দুই বিলিয়ন এই মাত্র দুই মাসের মধ্যেই পরিশোধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন আর বকেয়া আছে বড়জোর ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশা করছেন, রিজার্ভে হাত না দিয়েও যেভাবে দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি বকেয়া পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে, খুব দ্রুতই বাকি ঋণগুলোও পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
ব্যাংকিং সিস্টেমের জটিল হিসাব নিকাশের দিকে না তাকিয়েও যে বিষয়টা সহজেই উপলব্ধি করা যায়, সেটা হচ্ছে—আয় বেড়েছে আর বিপরীত দিকে চুরি থামানো গেছে। আর এই প্রক্রিয়াটি বেশ জোরে শোরে শুরু করার ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি বেড়েছে মানুষের আস্থা। আর একই সঙ্গে প্রবাসীদের মধ্যে বেড়েছে ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি ভরসা। এই সরকারের শ্লথ গতি নিয়ে অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও মানুষ অন্ততপক্ষে এতটুকু মনে করে যে, এরা আর যাই হোক চোর নয়। এদের কাছে আমাদের অর্থটা অনিরাপদ নয়।
একটা সুস্থ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় এই আস্থাটা খুবই জরুরি। অনেক বছর পরে হলেও, সেটাই দেখা যাচ্ছে এখন।