কেন পাহাড় ধসে পড়ছে বাংলাদেশে?
২৬ জুলাই ২০১৭এর মধ্যে গত জুনে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ধসে দেড়শ’র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ এ বছর এই পাঁচ জেলা বাইরে মৌলভীবাজারে পাহাড় ধস হয়৷ সেখানেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে৷
পাহাড়ের জীবনযাপন ও প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি রাখা অধ্যাপক দানেশ মিয়া এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের শিক্ষক৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত৷
পাহড়ধস ঠেকাতে শূন্যের কাছাকাছি চলে যাওয়া প্রাকৃতিক বনকে ফিরিয়ে আনার উপর গুরুত্ব দেন তিনি৷ তিনি মনে করেন, টানা ১০ বছর কোনোভাবে বিরক্ত না করলে এই বন ফিরে আসতে পারে৷
বাংলাদেশের পাহাড় ধসের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমেই তিনি এখানকার বর্তমান জন-মানচিত্র ও জীবন-যাপনের দিকে দৃষ্টি দেন৷
তিনি বলেন, আশির দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের মানুষদের নেয়া হয়েছে৷ তাদের জনসংখ্যা বেড়ে অনেক হয়ে গেছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যা ট্রাইবাল কমিউনিটিজকে ছাড়িয়ে গেছে৷
‘‘থাকা ও খাওয়ার জন্য সেখানে তাদেরকে কৃষি কাজ করতে হয়৷ ঘরবাড়ি বানাতে হয়৷ তারা সেটা পাহাড় কেটে করেন৷ পাহাড়িরা এখানে হাজার হাজার বছর ধরে থাকে৷ তাঁরা জানেন, কীভাবে পাহাড়কে ক্ষতি না করে কৃষি কাজ করতে হয়৷ কীভাবে পাহাড়কে ক্ষতি না করে ঘর বানাতে হয়৷’’
‘‘আমাদের সমতলের মানুষদের কিন্তু সেই জ্ঞান নাই৷ তাঁরা সেখানে সমতলের মতো করে ঘর বানাচ্ছে৷ পাহাড়কে কেটেকুটে সাবাড় করছে৷’’
পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে যদিও দুয়েকবার পাহাড় ধস হয়েছে৷ কিন্তু এত বিপর্যয় আগে কখনো হয়নি৷ এবার কেন বিপর্যয় হলো? – এমন প্রশ্নের জবাবে কথা বলেন তিনি৷
তিনি বলেন, এখানে পাহাড়কে আঘাত করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে আসছে, যাতে বড় ধরনের বিপর্যয় হচ্ছে৷
রাঙ্গামাটির ধসের ঘটনা পৃথিবীর বড় বড় ধসের কাছাকাছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারি হয়ে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত পাহাড় কেটে যে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, সেখানে ওয়াল দেয়া দরকার ছিল৷ তা দেয়া হয়নি৷ সে কারণে বৃষ্টিতে মাটি খসে পড়েছে৷ এখনো রাঙ্গামাটি পর্যন্ত বড় বাস-ট্রাক চলছে না৷
বন ও পরিবেশ বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, আমরা সব সময় বলতাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে ‘বায়ো ডাইভার্সিটি হটস্পট এরিয়া’৷ এখানে দীর্ঘ দিনের পুরনো প্রাকৃতিক বন ছিল৷ বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বন একবারে শূন্যের কাছাকাছি৷
‘‘এখানে ৯০’র দশকের পর অনেক প্ল্যান্টেশন হয়েছে৷ বনের কাভারেজ বেড়েছে৷ কিন্তু কোয়ালিটিটিভ বনায়ন হয়নি৷ খেয়াল করবেন, সেখানে বনায়নে মূলত বিদেশী বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়েছে৷’’
‘‘যেমন, সেগুন৷ প্রাকৃতিক বন কেটে এটা লাগানো হয়েছে৷ প্রাকৃতিক বনে মাটি ধারণের ক্ষমতা ছিল, সেটা এখন আর নেই৷ এই গাছের নীচে ঝোপও হতে চায় না৷ সেগুনের পাতা খুব অ্যাসিডিক থাকে৷’’
এ বছরের ধসের জন্য অতিবৃষ্টিকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে৷ সে জন্য এখন প্রস্তুতি নেয়া দরকার৷
তিনি জানান, এ সব বিষয়কে ডিল করতে পরিবেশ বিভাগ, আবহাওয়া বিভাগ, পার্বত্য প্রশাসনের কোনো পরিকল্পনা নাই৷ থাকলে জীবনক্ষয় কমানো যেত৷
প্রাকৃতিক বন উজাড় এবং পাহাড় কাটার কারণেই চট্টগ্রাম শহরেও ধস হয় বলে মূল্যায়ন তাঁর৷
তিনি বলেন, আমাদের পাহাড়গুলো বেলে দোঁয়াশ মাটির৷ এগুলো পাথরের পাহাড় হলে এ ধরনের ধস হতো না৷
প্রাকৃতিক বন পানিকে ধরে রেখে আস্তে আস্তে সরাতে সাহায্য করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বন থাকলে পানি নিয়ন্ত্রিত হয়৷ আমরা যেটাকে ‘ওয়াটার কনজার্ভেশন’ বলি৷ যখন আপনি প্রাকৃতিক বন সরিয়ে সেখানে গাছ লাগিয়ে দেবেন৷ তখন সেখানে এই ‘ওয়াটার কনজার্ভেশন’ কাজ করে না৷
‘‘তাতে সব পানি একসাথে মুভ করে৷ যা বেলে দোআঁশ মাটিকে গলিয়ে নীচের দিকে নিয়ে যায়৷ যে সব পাহাড় হেলে থাকে বা খাড়া, সেগুলো যদি বেলে দোআঁশ মাটির হয় এবং সেখানে প্রাকৃতিক বন না থাকে, তাহলে সেগুলো বেশি ঝুঁকি থাকে৷’’
এই সমস্যা সমাধানের পথ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ব্যক্তিদের সরিয়ে নিতে হবে৷
‘‘পাহাড়ে রাস্তাঘাট বা অন্য উন্নয়নমূলক কাজে পাহাড়কে ডিস্টার্ব না করার চেষ্টা করতে হবে৷ এরপরও যদি কাটতেই হয়, তাহলে ‘রিটেইনিং ওয়াল’ দিতে হবে৷’’
সেখানে প্রাকৃতিক বনকে উঠে আসার একটা সুযোগ দেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্যথায় কৃত্রিম বন দিয়ে পাহাড়কে ধরে রাখতে পারবেন না৷
‘‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনকে ১০ বছর আনটাচড রেখেছি, এখানে গভীর প্রাকৃতিক বন হয়ে গেছে৷ আপনি ইচ্ছা করলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে প্রাকৃতিক বনকে ফিরিয়ে আনতে পারেন৷’’
এই শিক্ষক-গবেষক জানান, বাংলাদেশের ভূমিধস নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নাই৷ এটা নিয়ে এ পর্যন্ত কেবল দু’টো কাজ হয়েছে৷ একটা একান্তই প্রকৌশল বিষয় নিয়ে৷ আরেকটা হচ্ছে, রেইনফল নিয়ে কক্সবাজারের একটা এলাকায় হয়েছে৷
এ কারণে কোন জায়গাগুলোতে ঝুঁকি আছে – সেটা সুনির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি এর জন্য অর্থায়ন না থাকাকে দায়ী করেন৷
নিজের একজন শিক্ষার্থী রাঙ্গামাটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে একটি গবেষণা করতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা নিশ্চিত নয়৷