পাঠ্যক্রম-পাঠ্যবই সংস্কার: কোন পথে শিক্ষা?
৪ অক্টোবর ২০২৪এই আগস্টের ঘটনা৷ তখন পতন হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের৷ ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে টাঙানো ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি৷ শিক্ষক এসে খুদে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘ছবিটা কে কে নামিয়ে ফেলতে চাও, হাতে তোলো৷’’ কেউ হাত তোলেনি৷ এবার শিক্ষক সুধালেন, ‘‘ছবিটা এখানে রাখতে চাও কে কে?’’ তখন সবাই হাত তুললো৷ তবুও ছবিটা রাখা হয়নি সেখানে৷ একজন অভিভাবক ফেসবুকে তুলে ধরেছেন এই বিবরণ৷
অক্টোবরে এসে সামাজিক যোগাযোগ্যমাধ্যমে আরেক অভিভাবক দিলেন আরেক তথ্য৷ তার সন্তানকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে প্রশংসাসূচক লেখাসহ সচিত্র অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়েছে শিক্ষকের নির্দেশনায়৷
দুটো ঘটনাই আসলে সিলেবাসে নেই৷ ঘটেনি সরকারের কথায়ও৷ শিক্ষকরাই বরং ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার প্রবণতা নিয়ে বসে আছেন৷ শিক্ষাখাতের সব কর্তার মাথায়ই তা আছে৷ তাই সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রদবদলের আওয়াজ উঠেছে৷ চব্বিশের হাওয়ায় এতে যুক্ত করা হচ্ছে ‘সংস্কার’ শব্দটি৷ কিন্তু ঘুরেফিরে সেই আগের মতোই৷
নতুন সরকার মানে নতুন পাঠ্যক্রম, নতুন পাঠ্যবই, নতুন ইতিহাস৷ বদল কতটা যৌক্তিক? বদল কতটা বিজ্ঞানসম্মত? বদল কতটা সময়োপযোগী? এসব প্রশ্ন সামনে রেখে কাজগুলো হচ্ছে না৷
শিক্ষাপদ্ধতি বারবার বদল, শিশুর ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে- জানতে চাইলে শিক্ষা গবেষক ও লেখক ফারহানা মান্নান ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, ‘‘এটা শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে৷ তবে অভিভাবকদের ওপর নাড়াচাড়া পড়ে সবচেয়ে বেশি৷ কারণ, অভিভাবকদের পুরো পাঠ্যক্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে একটু সময় দিতে হয়৷ কারণ, উনারা জানবেন, বুঝবেন, সহযোগিতা করবেন৷ নিজেদের মধ্যেও একটা বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে্৷ কারণ, যতই স্কুল পড়াক না কেন, অভিভাবকদের যদি একটা প্রভাব না থাকে, তাহলে যোগসূত্রটা কিন্তু ঠিক হয় না৷ এতে শেখার যে যাত্রা, সেটা যথাযথভাবে হয় না৷ তাই অদলবদল অভিভাবকদের মধ্যে সমস্যা তৈরি করে৷ উনারা কীভাবে বাচ্চাদের প্রস্তুত করবেন, সে জায়গাটায় উনারা হোঁচট খান৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত কারিকুলামের ধরন, পড়ার ধরনে যদি একাধিকবার অদলবদল হয়, সেটার সঙ্গে বাচ্চাদের তাল মেলাতে অসুবিধা হয়৷’’
যোগ-বিয়োগে যা যা
আওয়ামী লীগ আমলের শেষদিক নতুন একটি শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ চলছিল৷ সেখানে তাত্ত্বিকের চেয়ে ব্যবহারিক ছিল বেশি৷ পরীক্ষা-নম্বরের চেয়ে দক্ষতার দিকেই বেশি নজর রাখার আায়োজন ছিল সেখানে৷ কিন্তু যথাযথ প্রস্তুতির আগেই উদ্যোগটি বাস্তবায়নে হাত দেওয়া হয়৷ অথচ এর চাহিদামতো সরঞ্জাম আর প্রশিক্ষণ তখনো মেলেনি স্কুলে স্কুলে৷ ফলে এ নিয়ে হোঁচট খেতে শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক; তথা সব পক্ষই৷ আর বিরোধীদের বিরোধিতা করার প্রবণতার যে ব্যাপার, সেটা তো ছিলই৷ এই কারণে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরেই চলতি পাঠ্যক্রম বাদ দেওয়া, আর পাঠ্যবই পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়৷ হালে অবশ্য সেই ঘোষণা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ৷ তিনি প্রথমে বলেছিলেন, ‘‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়৷ তবে পরে তিনিই বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল নয়, সংশোধনের চেষ্টা করবো৷’’
তবে ঠিক আগের সরকারের কিছু কিছু বিষয় বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে এরইমধ্যে৷ নবম শ্রেণি থেকে আবার মানবিক, বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য বিভাগ আলাদা করা হচ্ছে৷ আসছে বছর পাঠ্যবইগুলোর প্রচ্ছদ বদলে ফেলা হবে৷ বদলাবে ভেতরের বিষয়৷ পরীক্ষাও আবার বাড়ছে৷ গত কিছুদিনে খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা জানিয়েছেন এসব৷
এদিকে নতুন সরকারের বই বদলের উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে৷ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি করেও তা বাতিল করা হয়৷ কারণ, কমিটির অন্তুত দুজন সদস্যকে মানতে পারেননি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের একাধিক নেতা৷ তাদের আপত্তিতে কমিটি বাতিলের বিষয়টি নিয়েও আরেকদফা সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার৷
শিক্ষাখাত নিয়ে এই পক্ষ-বিপক্ষ থাকার কারণ কী- এমন প্রশ্নে প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন খুব প্রকট৷ সামাজিক চিন্তাভাবনার মধ্যে নানারকম বৈপরীত্য আছে, প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে শিক্ষাটাকে দেখতে চান৷ এছাড়া এখানে অনেক বছর ধরেই শিক্ষার দুই-তিনটা মূলধারা রয়েছে৷ মাদ্রাসা শিক্ষা একভাবে চলেছে৷ বাংলামাধ্যম মূলধারার স্কুলগুলো একরকম৷ আবার ইংরেজিমাধ্যম স্কুল আছে৷ শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ধারা রয়েছে৷ সেসব জায়গা থেকেই বিতর্কগুলো তৈরি হয়৷''
শিক্ষাব্যবস্থা সময়োপযোগী করা কীভাবে সম্ভব হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা অনেক উদ্যোগ দেখলাম৷ উদ্যোগগুলো সফল হতে পারে না, যেহেতু বিরোধিতা থাকে৷ এছাড়া নতুন সরকার আসলে মনে করে তাদের মতো করে সবকিছু করতে হবে৷ এই মানসিকতা থাকলে আমরা এগুতে পারবো না৷ বারবার পথবদল করতে হচ্ছে, এটা ঠিক নয়৷ আমাদের রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটি এবং শিক্ষার ব্যাপারে যে ঐকমত্য দরকার সেই জায়গাটাতে পৌঁছাতে হবে৷’’