ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা রাজনীতির বাইরে নয়
৪ অক্টোবর ২০২৪ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিক্ষা ছিল একটি রাজ্যের বিষয়৷ অর্থাৎ, রাজ্যগুলি নিজের মতো করে নিজের রাজ্যে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারবে৷ আবার কেন্দ্রও কেন্দ্রীয় শিক্ষায়তনগুলির পাঠ্যক্রম নিজের মতো করে তৈরি করতে পারবে৷
১৯৭৬ সালে সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটিতে একটি সংশোধন করা হয়৷ শিক্ষাকে কেন্দ্র এবং রাজ্য দুইজনেরই আওতাভুক্ত করা হয়৷ অর্থাৎ, রাজ্যের শিক্ষানীতি রাজ্য তৈরি করতে পারলেও কেন্দ্র সেখানে নিজের অভিমত প্রকাশ করতে পারবে৷ বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই কাজটিই করে ইউজিসি বা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিটি৷ তারা একটি কেন্দ্রীয় নিয়মাবলি তৈরি করে৷ রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেদের মতো করে সেই নিয়মাবলি নিজেদের রাজ্যে রূপায়ন করে৷ তবে বেসরকারি বা অসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়মাবলি মানতে বাধ্য না-ও থাকতে পারে৷
স্কুল পাঠ্যক্রম
স্কুলের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব বোর্ড আছে৷ রাজ্যের সেই বোর্ড নিজেদের সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম তৈরি করে৷ সেখানে কেন্দ্রের কোনোরকম হস্তক্ষেপ থাকে না৷ সেখানে রাজ্য সরকার এবং রাজ্য সরকারের কমিটি নিজেদের মতো করে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারে৷ তবে খেয়াল রাখা হয়, তা যেন বাকি দেশের পাঠ্যক্রম থেকে খুব বেশি আলাদা না হয়৷
রাজ্য সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের বোর্ডও যে কোনো রাজ্যে তাদের স্কুল খুলতে পারে৷ সেখানে আবার রাজ্য সরকারের পাঠ্যক্রম নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটির তৈরি পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়৷ তাদের বোর্ড হলো কেন্দ্রীয় বোর্ড৷ আবার এই দুই বোর্ডের বাইরে অসরকারি বোর্ডও আছে৷ যারা তাদের পাঠ্যক্রম নিজেদের মতো করে তৈরি করতে পারে৷ গোটা দেশেই সেই বোর্ড তাদের স্কুল তৈরি করতে পারে৷
বিশ্ববিদ্যালয় স্তর
স্কুল পাশ করার পর ছাত্রছাত্রীরা যখন কলেজে ভর্তি হয়, তখন তারা রাজ্যের বা কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালিত কলেজে ভর্তি হয়৷ তবে এর বাইরে অসরকারি বা বেসরকারি কলেজও আছে৷ রাজ্য বা কেন্দ্রের কলেজ হলে এর একটি নিয়ামক সংস্থা আছে৷ যার নাম ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন৷ এই কমিশনের সুপারিশ রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই বিশ্ববিদ্যালয়কেই মেনে চলতে হয়৷ তবে প্রয়োজন মতো রাজ্য এবং কেন্দ্র তাদের পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারে৷
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
আপত চোখে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার ভিতটি খুব পোক্ত৷ যেহেতু এখানে কোনো একটি সরকার বা একটি কমিটি গোটা ব্যবস্থার নিয়ামক নয়, তাই এখানে রাজনীতি ঢোকার সুযোগও কম৷ কিন্তু বাস্তব অন্যরকম৷
রাজ্য হোক বা কেন্দ্র-- যে দল যখন যেখানে ক্ষমতায় আসে, তারা নিজেদের মতো করে শিক্ষাব্যবস্থায় বদল ঘটানোর চেষ্টা করে৷ সার্বিক পরিকাঠামোয় নয়, রাজনৈতিক ভাষ্যে৷ ইতিহাস এবং সাহিত্যের বিষয়গুলিতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে৷
উদাহরণ দেওয়া যাক৷ একুশ শতকের একেবারে গোড়ায় বিজেপি যখন প্রথমবারের জন্য ভারতে ক্ষমতায় আসে অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরে, সে সময় কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন মুরলী মনোহর জোশী৷ সেই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বই থেকে মুঘল আমলের ইতিহাস কার্যত তুলে দেওয়া হয়৷ এ নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি৷ কিন্তু কেন্দ্রের সেই সিদ্ধান্ত অটুট ছিল৷ কিন্তু রাজ্যগুলির পাঠ্য বইয়ে মুঘল ইতিহাস যেমন থাকার তেমনই রাখা হয়৷ কেন্দ্র এক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে কোনো নির্দেশ বা চাপ দিতে পারেনি৷
আবার নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার স্থির করে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হবে৷ বহু বিতর্ক সত্ত্বেও সরকার কয়েকবছরের জন্য তা করতে সক্ষম হয়েছিল৷ কেন্দ্র আপত্তি জানালেও রাজ্যকে পরাস্ত করতে পারেনি৷
যত দিন গেছে রাজনৈতিক দলগুলির চাপ ততই বেড়েছে শিক্ষাব্যবস্থার উপর৷ যে কারণে বাম সরকারের পতনের পর পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে স্কুল পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাও স্থান পেয়েছে স্কুল পাঠ্যে৷ উত্তরপ্রদেশের যোগী-রাজ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ্য বই থেকে তুলে সেখানে বাবা রামদেবের রচনা ঢোকানো হয়৷ আর কেন্দ্রীয় সরকার তো গোটা ইতিহাসই নতুন করে লেখার ফরমান জারি করেছে৷
তা যদি হয়ও অবিজেপি রাজ্যগুলি সে পথে হাঁটবে না, তা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু রাজনীতির এই টানাপড়েনে বহু সময়েই দেখা যায় ছাত্ররা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে৷ রাজ্য বোর্ডের স্কুল থেকে কেন্দ্রীয় বোর্ডে কোনো ছাত্র বদলি হলে তার কী দশা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
সংবিধান চেয়েছিল শিক্ষাকে যতটা সম্ভব রাজনীতিমুক্ত রাখতে৷ সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদে৷ কিন্তু যে দেশে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতি জড়িয়ে সেখানে রাজনীতি সংসর্গহীন শিক্ষা আসলে সোনার পাথরবাটি৷