পশ্চিমবঙ্গে চাকরি চাইলে জুটছে মার!
২২ জুলাই ২০২১দিন কয়েক আগের ঘটনা। কলকাতার ভবানী ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন একদল চাকরিপ্রার্থী। তারা আবেদন জানিয়ে, পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি পেয়েছেন। অনেকের কাছে নিয়োগপত্র আছে। কিন্তু করোনার কারণে ও আইনি জটিলতায় তারা চাকরি পাননি। তাই বিক্ষোভ। ডিসি সাউথ ভবানী ভবন থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে কথাও বলেন। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ থামেনি। এরপর পুলিশ জানিয়ে দেয়, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে না গেলে লাঠিচার্জ হবে। হলোও তাই। হবু পুলিশদের লাঠিপেটা করলেন বর্তমান পুলিশরা। চাকরি চাওয়ার অপরাধে।
এরপর কোনো পুলিশের শাস্তি হয়েছে বা প্রশাসনিক স্তরে এনিয়ে জলঘোলা হয়েছে, এমন খবর নেই। রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল পদে পরীক্ষা দিয়ে আট হাজার ৪১৯ জন পাস করেন। এর মধ্যে দুই হাজার ৮০০ জনের নিয়োগ হয়েছে। বাকিদের নিয়োগ আইনি জটিলতায় আটকে গেছিল। আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। সেই সময়সীমাও পেরিয়ে গেছে বলে বিক্ষোভকারীদের দাবি। কিন্তু তাদের চাকরি পাওয়ার বিষয়টি এগোচ্ছে না। তাই তারা দিশানির্দেশ পেতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। চাকরির বদলে জুটেছে পুলিশের লাঠির বাড়ি।
কবে তারা চাকরি পাবেন এইটুকু জানিয়ে দিলেই সমস্যা মিটত। সেটাও কেউ জানাননি। করোনাকালে প্রতিটি পরিবার আর্থিক দিক থেকে চাপে। অনেকের চাকরি গেছে। অনেকের বেতন কমেছে। অনেক ব্যবসায়ীকে দীর্ঘদিন ধরে দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। এই চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, তারা অনেকে পুলিশের চাকরি পেয়ে যাওয়ায় অন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সব চেয়ে বড় কথা, এই হতাশার পরিস্থিতিতে তাদের ন্যায্য দাবিপূরণ দূরে থাক, কেন লাঠি মারা হলো? এই অসংবেদনশীল মনোভাব কেন?
উদাহরণ শুধু এটাই নয়। পার্শ্ব শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। রাজ্যে ৪৮ হাজার পার্শ্ব শিক্ষক আছেন। বাম আমলেই তাদের নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের বেতনের একটা অংশ কেন্দ্র দেয়। বাকিটা রাজ্য। এখন প্রাথমিকের পার্শ্ব শিক্ষক ১০ হাজার টাকা পান। অন্যরা ১৩ হাজার। অথচ, নিয়মিত শিক্ষকদের মতো সব কাজই তারা করেন। ক্লাস নেন, খাতা দেখেন, পরীক্ষার ডিউটি দেন। তাদের দাবি, তাদেরও নিয়মিত শিক্ষক করা হোক এবং সব সুযোগসুবিধা দেয়া হোক। এই দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তারা আন্দোলন করছেন। আন্দোলন করতে গিয়ে মার খেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে রোদে-জলে তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের কথা শোনে কে?
দাবিটা অন্যায্য নয়। তৃণমূল কংগ্রেস ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই শিক্ষকদের বেতন তিন শতাংশ বাড়ানো হবে। আর ৬০ বছর বয়সে অবসর নেয়ার পর তাদের তিন লাখ টাকা দেয়া হবে। ইস্তাহারে তৃণমূল প্রচুর শিক্ষক নিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তা হলে এই শিক্ষকদের সেখানে চাকরি দিতে অসুবিধা কোথায়? সেই সঙ্গে মানবাধিকারকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে কেন মার খেতে হবে তাদের?
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''একদিকে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ জানানোর অধিকার গলা টিপে হত্যা করছে।'' তার বক্তব্য, ''সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো, সম কাজের সম বেতন দিতে হবে। এই যে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে তা মধ্যযুগীয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এবং খুব সামান্য টাকা দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনের পথে যাব। দশ দিন সময় কর্তৃপক্ষকে দিয়ে এসেছি। তার মধ্যে কিছু না হলে আন্দোলন হবে।''
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে গত এপ্রিলে বেকারত্বের হার ছিল সাত দশমিক ছয় শতাংশ। এটা জাতীয় হারের থেকে কম। তবে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার আগের থেকে অনেকটা বেড়েছে। আর করোনাকালে প্রায় প্রতিটি পরিবারের উপর আর্থিক চাপ বাড়ছে, সেটা সর্বজনগ্রাহ্য সত্য।
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, ''চাকরি পেয়েও নিয়োগের দাবিতে বা পাকা চাকরির দাবিতে আন্দোলনে নামলে মার খেতে হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। সমান কাজ করলে সমান বেতন দিতে হবে, এই নীতি তো প্রশ্নাতীত। কিন্তু এখন সরকার সমানে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করছে।'' শুভাশিসের মতে, ''হতে পারে, সরকারের টাকার টানাটানি আছে। কর্মীদের বেতন এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করতে সিংহভাগ অর্থ খরচ হচ্ছে। তাই বাড়তি চাপ সরকার নিতে চায় না।''
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। আর সরকার যখন শিক্ষকদের চাকরি দেবে বলেছে তখন এই পার্শ্ব শিক্ষকদের সেখানে নিয়োগ করলে ক্ষতি কোথায়? তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে 'আমার লোক, তোমার লোকের নীতি'। ঢুকে পড়েছে রাজনীতি। আর প্রশাসনের বরাবরই একটা সংবেদনহীন চেহারা আছে। পশ্চিমবঙ্গে তা মাঝেমধ্যেই প্রকট হচ্ছে।
জিএইচ/এসজি(হিন্দুস্তান টাইমস, আনন্দবাজার)