পশ্চিমবঙ্গে নিগৃহীত শিক্ষকরা
২০ আগস্ট ২০১৯সরকারি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলে পার্শ্ব–শিক্ষকের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৫৷ কিন্তু পার্শ্ব–শিক্ষকদের নিজেদের হিসেবে ওঁদের সংখ্যা ৪৮ হাজার মতো৷ এঁরা কেউ পূ্র্ণ সময়ের শিক্ষকদের মতো মাস গেলে বেতন পান না৷ ওঁদের একটা ভাতা দেওয়া হয়, যার পোশাকি নাম ‘সাম্মানিক'৷ তার পরিমাণ এতই কম, যে পার্শ্ব–শিক্ষকদের তাতে সম্মানরক্ষা তো হয়ই না, এমনকি সংসার চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ উচ্চ প্রাথমিক স্তরে যে পার্শ্ব–শিক্ষক ক্লাস নেন, তাঁর মাসিক ভাতা ১৩ হাজার টাকা৷ ২০১৫ সাল থেকে ‘এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ড ফান্ড' বাবদ কিছু টাকা কাটা চালু হয়েছে৷ এছাড়া বাদ যায় বৃত্তি কর৷ ওঁরা হাতে পান ১১ হাজার ৩৩০ টাকা৷ এই নিখুঁত হিসেব ডয়চে ভেলেকে দিলেন বর্ধমানের এক সরকারি স্কুলের পার্শ্ব–শিক্ষক চন্দ্রচূড় গাঙ্গুলী৷ আর প্রাথমিক স্তরের পার্শ্ব–শিক্ষকরা ১০ হাজার টাকা পান, হাতে আসে আট হাজার ৮০০ টাকা৷ আজকের দিনে এই সামান্য টাকায় যেহেতু চালানো সম্ভব নয়, ওরা নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হন৷ তার মধ্যে হকারি, ভ্যান রিকশা চালানোর মতো কায়িক পরিশ্রমের কাজও আছে৷ ফলে বাধ্য হয়েই ওরা দাবি তুলেছেন— সমান কাজ, সম বেতন৷ অর্থাৎ, যেহেতু একজন পূর্ণ শিক্ষক রোজ যে কাজ করেন, পার্শ্ব–শিক্ষকরাও সেই কাজই করেন, ওঁদের পারিশ্রমিকও সমান হওয়া উচিত বলে ওঁরা মনে করেন এবং সেই দাবিতে সম্প্রতি পথে নেমেছিলেন৷
কিন্তু সরকারের তরফে সহানুভূতি বা আশ্বাসের বদলে ওরা পেলেন পুলিশের লাঠি৷ পার্শ্ব–শিক্ষিকা সুচিত্রা দাস ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ওরা প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষক–শিক্ষিকা ১৬ আগস্ট কলকাতায় জমায়েত হয়ে মিছিল করে যান পূর্ব কলকাতার সল্ট লেকের বিকাশ ভবনে, যেখানে রাজ্য শিক্ষা মন্ত্রকের দপ্তর৷ লক্ষ্য ছিল শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির হাতে নিজেদের দাবিদাওয়ার লিখিত সনদটি তুলে দেওয়া৷ কিন্তু রাজ্যের একটি আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে তলব পড়ায় শিক্ষামন্ত্রীকে সেদিন সিবিআইয়ের দপ্তরে হাজিরা দিতে হয়েছিল৷ ফলে তার দেখা পাননি তারা৷ তখন বিকাশ ভবনের সামনেই ধর্নায় বসার সিদ্ধান্ত হয়৷ সুচিত্রা দাস জানাচ্ছেন, পুলিস তার পর কীভাবে মিথ্যে কথা বলে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়, এবং কার্যত তাড়া করে ট্রেনে–বাসে জোর করে উঠিয়ে দিয়ে শহরছাড়া করার চেষ্টা করে৷ তার পর শেষ পর্যন্ত কল্যাণীতে অবস্থানরত শিক্ষক–শিক্ষিকাদের ওপর পড়ে পুলিশের লাঠি৷ বেদম মারা হয়, এমনকি নারীদেরও৷ তাঁদের শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা করে পুলিশ৷ ‘আমরা কিন্তু কেউ ফিরে যাইনি!' তেজিয়ান গলায় বললেন সুচিত্রা৷
শিক্ষিকাদের ওপর পুরুষ পুলিশকর্মীদের অত্যাচারের ঘটনাটি বিশেষ করে ভাইরাল হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়৷ সাড়া পড়েছে, জোরালো প্রতিবাদ আসছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে৷ চিত্রপরিচালক অপর্ণা সেন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে টুইট করেছেন, যে আপনারই দায়িত্ব দোষীদের শাস্তি দেওয়ার! অপর্ণা জানিয়েছেন, তিনি শহরে থাকলে প্রতিবাদী পার্শ্ব–শিক্ষকদের পাশে গিয়ে অবশ্যই দাঁড়াতেন৷ ‘‘শিক্ষকদের লাঠিপেটা করছে পুলিশ, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করেছে— কী হচ্ছে টা কী আমাদের রাজ্যে!'', টুইটে ক্ষোভ অপর্ণার৷
বাংলার শিক্ষকসমাজও এই ঘটনার নিন্দায়, প্রতিবাদে সরব৷ ‘‘সরকারপন্থী কয়েকজন বাদ দিয়ে, সকলেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ আজও করে চলেছেন৷ রাস্তায় নেমেছেন, নামছেন, মিছিল করছেন'', বললেন চন্দ্রচূড় গাঙ্গুলী৷ তিনি এক প্রবীণ শিক্ষিকার হেনস্থার কথা জানালেন, যিনি শরীরে জড়িয়ে রেখেছিলেন জাতীয় পতাকা৷ সেই পতাকাও পুলিশ টেনে হিঁচড়ে কেড়ে নিয়ে পায়ে মাড়িয়েছে৷ চন্দ্রচূড় বলছেন, এই বর্বরতার প্রতিবাদ যাতে সারা সমাজে এবার ছড়িয়ে পড়ে, সেই চেষ্টা ওরা করছেন৷ আন্দোলন থামছে না, থামার প্রশ্নই নেই৷
আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চিরাচরিত নিয়মে এখন রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে৷ শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠি, শিক্ষকদের অপমান নিয়ে তাঁর পাল্টা যুক্তি, সম্মান দিয়েছি বলেই ক্ষমতায় এসে ওঁদের ভাতা বাড়িয়েছি৷ অসম্মানের প্রশ্ন উঠছে কেন!