পার্শ্বশিক্ষকরাই ভরসা, তারাই বঞ্চিত
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১কলকাতার সল্ট লেকে, রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের অদূরে, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়–এর মূর্তির ঠিক উল্টোদিকে, ফুটপাথের ওপর ছাউনি খাটিয়ে বসে আছেন তারা৷ গত দু মাস ধরে৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার সরকারি স্কুলের পার্শ্বশিক্ষকেরা৷ চাকরির স্থায়ীকরণ এবং নির্দিষ্ট বেতনকাঠামোর দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন, কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না৷ ওদের রাজ্যব্যাপী সংযুক্ত জোট ‘পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চ’–এর পাশেই একটি ছোট ছাউনি, যেখানে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন স্কুল–শিক্ষকের যোগ্যতামানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও চাকরি না পাওয়া আবেদনকারীরা৷ আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি জোট অবস্থান–বিক্ষোভ করছেন, যাঁরা বেতন পাচ্ছেন না৷
সমস্যা হচ্ছে, তাদের আবেদন–নিবেদন শুনতেও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর বিরক্তি৷ অবরোধ–বিক্ষোভ হলে বরং পুলিস দিয়ে লাঠিপেটা করাতে অনেক তৎপর সরকার৷ এর আগে ২০১৯ সালে আন্দোলনরত পার্শ্বশিক্ষকরা বেধড়ক মার খেয়েছিলেন কল্যাণীতে৷ ২০২১ সালেও ফের মার খেলেন বিধানসভা পর্যন্ত মিছিল করে যেতে গিয়ে৷ বুকে পুলিসের বুট–পরা পায়ের লাথি খেয়েছেন শিক্ষকরা, বলছিলেন পার্শ্বশিক্ষক চন্দ্রচূড় গাঙ্গুলি৷ আর এক পার্শ্বশিক্ষক ভগীরথ ঘোষ, যিনি তাদের ঐক্য মঞ্চের যৌথ রাজ্য আহ্বায়কের অন্যতম, বিদ্রূপের সুরেই বললেন, ‘‘যেভাবে কেন্দ্রের টাকা এরা নিয়ে আসছে এবং নয়ছয় করছে— মেলা, খেলা, জুতো, ছাতা, ব্যাগ, সেই পদ্ধতিটা বন্ধ হোক৷ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানো আমাদের মূল লড়াই৷ সেই সঙ্গে শিক্ষকদের বাঁচানো৷’’ ভগীরথবাবুর কটাক্ষ, চলতি সরকারের ১০ বছরের যদি হিসেব দেখেন, এই সময়ই বেশিরভাগ ছাত্র–ছাত্রী বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে৷ অথচ এরাই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে৷
পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চের আক্ষেপ, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে মমতা ব্যানার্জি পার্শ্বশিক্ষকদের পক্ষে কথা বলেছিলেন৷ ক্ষমতায় এসে, মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে পার্শ্বশিক্ষকদের স্থায়ীকরণের কথা বলেছিলেন৷ সামনে আবার ভোট, এখন আবার মুখ্যমন্ত্রীর মুখে পার্শ্বশিক্ষকদের কথা শোনা যাচ্ছে৷ রাজ্য বিধানসভায় সদ্য পেশ হওয়া অন্তর্বর্তী বাজেটে তিনি পার্শ্বশিক্ষকদের ভাতা বছরে তিন শতাংশ হারে বৃদ্ধি এবং পেনশন চালুর কথা ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু এর মধ্যেও ফাঁকি আছে৷ ঐক্য মঞ্চের অপর আহ্বায়ক মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝালেন, আগের সরকার তিন বছর অন্তর পাঁচ শতাংশ হারে ভাতা বৃদ্ধির কথা বলেছিল৷ মমতা ব্যানার্জির সরকার ২০১৮ সাল থেকে সেটা বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন আবার বছরে তিন শতাংশের কথা বলছে৷ অর্থাৎ ২০১৮, ১৯, ২০ সালের প্রাপ্য বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হবেন পার্শ্বশিক্ষকেরা৷ ফাঁকি আছে পেনশনের ক্ষেত্রেও৷ মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘‘অবসরকালীন এক লাখ টাকা, যেটা বিগত সরকার দিয়ে গিয়েছিল, সেটাকেই নতুন মোড়কে মুড়িয়ে তিন লাখ টাকা অবসরকালীন ভাতা ঘোষণা হল৷ এটা এত দেরি করে করার পিছনে একটা কারণ আছে৷ আমাদের যে পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল, তার বয়সের ঊর্ধসীমা ছিল ৪৫ বছর৷ ৪৫ বছর বয়সে যারা চাকরি পেয়েছিল, তারা এক বিরাট সংখ্যা৷ ২০১৯ সালে এদের রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল৷ সেই জন্যেই সরকার চুপ করে বসেছিল৷’’
সরকারের এই লাগাতার ছল–চাতুরিতে পার্শ্বশিক্ষকরা এখন তিতিবিরক্ত৷ তারা এতদিন যদিও আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরেই রেখেছিলেন, কিন্তু ভোট যত এগিয়ে আসছে, সরকার–বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলি উৎসাহিত হচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়াতে৷ তার পরেও অবশ্য পার্শ্বশিক্ষকদের ছাউনির যে অংশ বক্তাদের জন্য নির্দিষ্ট, তার মুখোমুখি দেখা গেল প্ল্যাকার্ড— ‘অরাজনৈতিক বক্তব্য রাখার জন্য ধন্যবাদ’৷ তার কারণ, রাজনৈতিক স্বীকৃতি নয়, ওঁরা স্রেফ প্রাপ্য অধিকারটুকুই চাইছেন৷