নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক
২ জানুয়ারি ২০১৮এর জেরে অসমের কাছাড় জেলার ময়নাপুরে আত্মহত্যা করেছেন হানিফ খান নামে বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি৷ দীর্ঘ ২৫ বছর অসমের বাসিন্দা হানিফ ও তাঁর পরিবার৷ কিন্তু তালিকায় হানিফ-সহ পরিবারের কারও নাম নেই৷ এরপরেই আত্মহত্যা করেন তিনি৷ হানিফের মতোই নাগরিকপঞ্জিতে নাম নেই অসংখ্য বাঙালির৷ দীর্ঘ ৪০ বছর অসমে বাস করেও নাম বাদ পড়েছে বেশ কিছু বাঙালি পরিবারের৷ উল্লেখযোগ্যভাবে ‘অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন' (আসু)-র উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যের পরিবারেরও কারও নাম নেই নয়া তালিকায়৷ দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ শরণার্থী অনুপ্রবেশ রুখতে আসুর হয়ে কাজ করছেন তিনি৷
এদিকে বহু বছর ধরে ফেরার উলফা জঙ্গি পরেশ বড়ুয়ার নাম রয়েছে নয়া নাগরিকপঞ্জির প্রথম দিকেই৷ তালিকাগুলি সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ও সেবা কেন্দ্রে দেখা যাবে৷ ১ জানুয়ারি সকাল থেকে রাজ্যের বিভিন্ন এনসিআর কেন্দ্রে রাজ্যবাসীকে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রুখতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য৷ খসড়ার প্রথম তালিকায় ৩ দশমিক ২৯ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে ১ দশমিক ৯ কোটি নাগরিক জায়গা পেয়েছেন৷ নাগরিক তালিকায় জায়গা পাননি ১ দশমিক ৩৯ কোটি৷ এই ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শিলচর-সহ অসমের বিভিন্ন অংশ৷ ৬০ বছর পর প্রথম প্রকাশ্যে এসেছে এই তালিকাটি৷ অসমের ৪২০০ একর এলাকাজুড়ে প্রথম এই খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে৷
এই নাগরিকপঞ্জী ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা ও টেনশনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে গোটা অসমে৷ অনেকেই মনে করছেন, এর পেছনে রয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি-র নিজস্ব রাজনীতি৷ সব দিক মাথায় রেখে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলাতে গোটা রাজ্য নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে৷ তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, যাঁদের নাম প্রথম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই৷ কারণ প্রতিটি পরিবারের সব সদস্যের নাম-বংশপঞ্জি যাচাই করার প্রক্রিয়াটি জটিল ও দীর্ঘ৷
ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অসমছাড়া করার পরিকল্পনা অনেকটাই স্পষ্ট এই তালিকায়৷ তাই সবচেয়ে বেশি নাম বাদ পড়েছে বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায়৷ নাগরিক তালিকায় নাম নেই এআইইউডিএফ সুপ্রিমো, সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল ছাড়াও বিরোধী দলের চার বর্তমান বিধায়কের৷
ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল মাঝরাতে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করেন প্রথম তালিকা৷ তাঁর আশ্বাস, চলতি বছরেই পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত হবে৷ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘বাকিদের নাগরিকত্ব যাচাই চলছে৷ উদ্বেগের কিছু নেই৷'' কিন্তু ঘটনা হলো, বাদ পড়ার ধরনটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক৷ বরাকে বাঙালিদের বসবাস প্রায় ১০০ শতাংশ৷ আর এখানেই এনআরসি তালিকায় নাম নথিভুক্তির হার সবচেয়ে কম৷ বরাকের অঘোষিত রাজধানী শিলচরে মাত্র ২৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষের আবেদন গ্রাহ্য হয়েছে৷ গোটা কাছাড় জেলাতে এই সংখ্যা ৩৫ দশমিক ২৪ শতাংশ৷ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জ জেলায় ৪০ শতাংশ নাম উঠেছে এনআরসিতে৷ বরাকের সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতি উদারবন্ধ মহকুমায়৷ সেখানে ৫০ দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল অবশ্য অভয় দিয়ে গুয়াহাটিতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷'' দ্বিতীয় তালিকায় বৈধ নাগরিকদের নাম থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন৷
অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়াতে নজরদারি শুরু হয়েছে৷ এই অবস্থায় প্রতিবাদে শামিল হতে সাহসও পাচ্ছেন না নাগরিকেরা৷ রাজনৈতিক দলগুলির এই কাজিয়ার মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে সংখ্যালঘুদের৷ নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ শিলচর থেকে বলেছেন, ‘‘সবাই হ্যাপি নিউ ইয়ার পালন করলেও অসমের বাঙালিদের কোনো আনন্দ নেই৷ নতুন বছর আমাদের কাছে অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে৷ ৭০ শতাংশ বাঙালির নাম বাদ৷ ইতিমধ্যেই একজন আত্মঘাতীও হয়েছেন৷''
বিশিষ্ট আইনজীবী হাফিজ চৌধুরি বলেন, ‘‘প্রথম তালিকা ভুলে ভরা৷ একই পরিবারের কারও নাম আছে, কারও নেই৷ ভরসা তাই এখন দ্বিতীয় তালিকা৷''
এই তালিকা নিয়ে আপনার বক্তব্য লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷