1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভাষা দিবসের ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তে বিতর্ক

১৯ মে ২০১৭

শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস৷ প্রতি বছর দুই বাংলায় শ্রদ্ধায়-স্মরণে ওই দিনটি পালিত হলেও আর একটি দিন চলে যায় প্রায় নীরবেই৷ সিংহভাগ বাঙালিকে সজাগ না করে এবারও হয়ত চলে যাবে ১৯ মে৷

https://p.dw.com/p/2dD73
Indien Politiker Sarbananda Sonowal
অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালছবি: Imago/Hindustan Times

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে রফিক-সালাম-বরকতরা প্রাণ দিয়েছিলেন৷ সেই আন্দোলন ও বলিদান বাংলাভাষীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, ভাষার জন্য জীবন বাজি রাখার উৎসাহ দিয়েছিল৷ তাই সেই ঘটনার ৯ বছর পর বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিলেন এ পারের বাঙালিরা৷ সেই ইতিহাস এই প্রজন্ম ক্রমে ভুলতে বসেছে৷

ভাষা শহিদদের স্মরণের এই দিনটিকে ঘিরে যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে৷ অসমের বিজেপি সরকার এ দিনের সরকারি ছুটি বাতিল করে দিয়েছে৷ এর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনেও ছুটি বাতিল করেছে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালের সরকার৷ অসমের বাঙালি সমাজ এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ অসম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অসমিয়া ছাড়া আর কোনও জাতির উৎসবে ছুটি দিতে রাজি নয়৷

অসমে বিজেপি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে: সুস্মিতা দেব

এই বিতর্কে আলোকপাত করার আগে এ পারের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একবার নজর দেওয়া দরকার৷ স্বাধীন ভারতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বাঙালিদের বাস৷ অসম রাজ্যের কাছাড় জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে হাজার হাজার বাঙালি থাকতেন৷ সে সময় অসমিয়ারা মনে করেছিলেন, বিপুল সংখ্যক বাঙালির বাস তাদের অধিকারকে খর্ব করছে৷ আর বাঙালিদের জন্য যখন আলাদা একটি রাজ্য রয়েছে, তখন আর অসমে থাকা কেন? জাতিবিদ্বেষী এই মনোভাব ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে, অসমে বাঙালিদের বহিষ্কারের আশঙ্কা বাড়তে থাকে৷ দুই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির একটি সিদ্ধান্ত আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়৷ ১৯৬০-এর এপ্রিলে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, অসমিয়াই হবে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা৷ অর্থাৎ, বাঙালিদেরও অসমিয়াতেই কাজ সারতে হবে৷ সে বছর জাতিবিদ্বেষের জিগির এতটাই বাড়তে থাকে যে, হাজার হাজার বাঙালি অসম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যেতে থাকেন৷ বিভিন্ন জেলায় বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা৷ অনেকের প্রাণ যায়৷ যখন পরিস্থিতি এমনই অগ্নিগর্ভ, তখন অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা’র একটি সিদ্ধান্তে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায়৷ প্রদেশ কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে প্রশাসনিক রূপ দিয়ে চালিহা ঘোষণা করেন, অসমিয়াই হবে রাজ্যের সরকারি কাজকর্মের ভাষা৷

যাঁদের ঝুলিতে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় উত্তরাধিকার, তারা এতে পিছু হঠবেন কেন! অসমের বাঙালিরা এবার জোরালো প্রতিবাদ শুরু করলেন৷ ১৯৬১ সালে তৈরি হলো কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ৷ ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয় প্রতিবাদে, পালিত হয় সংকল্প দিবস৷ ২৪ এপ্রিল রাস্তায় নামে বাঙালিরা৷ শুরু হয় সত্যাগ্রহ৷ বরাক উপত্যকার গ্রাম-শহর ঘুরে সত্যাগ্রহীরা পদযাত্রা করেন, প্রচার চালান বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার দাবিতে৷ পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকদের বিরুদ্ধে যদি ওপারের বাঙালিরা রক্ত দিতে পারে, তাহলে অসমের বাঙালিরা পারবে না কেন? আন্দোলনকারীরা ঘোষণা করেন, বাংলাকেও অসমের কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, না হলে ১৯ মে ধর্মঘটে সব স্তব্ধ করে দেবে বাঙালিরা৷

এটা ক্ষমতাসীন দলের উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রকাশ: শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে৷ অসম সরকার অনড়, বাঙালিরাও দাবি থেকে সরবে না৷ সরকার দাবি খারিজ করে ধর্মঘট ব্যর্থ করার প্রস্তুতি নেয়৷ শিলচরের রাস্তায় নামে পুলিশ৷ ১৯ মে সকাল থেকে শুরু হয় মিছিল, বিক্ষোভ৷ দিকে দিকে চলতে থাকে পিকেটিং৷ ১৪৪ ধারা অমান্য করায় অনেক সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ শিলচর স্টেশনে রেল অবরোধ করে উত্তেজিত জনতা৷ অসম রাইফেলস অবরোধ তুলতে গুলি চালায়৷ গুলিতে শহিদ হন ১১ জন ভাষাসৈনিক কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তারিণী দেবনাথ, সুনীল সরকার ও সুকুমার পুরকায়স্থ৷

 এই আত্মবলিদান অসমে বাংলাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ রফিক-সালাম-বরকতদের সঙ্গে কমলা-চণ্ডী-সুকুমাররা প্রমাণ করেছেন, ভাষার যে শক্তি, তাকে হারিয়ে ধর্ম কখনও বাঙালিদের বিভাজিত করতে পারবে না৷ মাতৃভাষার সূত্রেই অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার বন্ধন, দেশে-দেশে, কালে-কালে৷

এমন গৌরবময় ইতিহাস সত্ত্বেও অসম সরকার ১৯ মে-র ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সমালোচনায় মুখর হয়েছে বাঙালিরা৷ এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবের স্ত্রী, শিলচরের কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেবের অভিযোগ, ‘‘অসমে বিজেপি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে৷ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামগ্রিকভাবে রাজ্যের অসমিকরণ করার চেষ্টা করছে তারা৷ শুধু অসমিয়াদের উৎসব গুরুত্ব পাবে, অন্যদের নয়৷ সংখ্যালঘুদের শবেবরাতের ছুটি তো বাতিল করেছেই, এমনকী দুর্গাপুজোর ছুটিও ওরা কমিয়ে দিচ্ছে৷ আপার অসমে বাঙালিরা এটা বলতেই ভয় পায় যে, তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা!’’ সাংসদ জানান, ১৯ মে-র ছুটি বহাল রাখার দাবি জানিয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন৷ সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷

শহিদদের স্মরণ আমাদের কর্তব্য: চিত্রা লাহিড়ী

শিলচরের বাঙালিরা ভাষা দিবসে এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাবেন৷ শিলচরের ভূমিপুত্র প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সুহৃদ ও কাছাড় কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের ক্ষোভ, ‘‘অসমের বহুত্ববাদকে অস্বীকার করাই এই রাজ্যের রাজনীতির একটি হাতিয়ার৷ তাই ১৯ মে-র ছুটি বাতিল করা হয়েছে৷ এটা ক্ষমতাসীন দলের উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রকাশ৷ ভারতীয় বহুজাতিকতাকে যারা খারিজ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সকলেরই প্রতিবাদ জানানো উচিত৷’’

ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্রা লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘এতদিন ধরে যে দিনটি বাঙালিরা পালন করে আসছেন, তার মর্যাদাহানি করা উচিত নয়৷ শহিদদের স্মরণ আমাদের কর্তব্য৷’’

শুক্রবার কার্জন পার্কের ভাষা উদ্যানে এবারও পালিত হবে ভাষা দিবস৷ কলকাতা স্মরণ করবে উনিশের শহিদদের৷

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷