দেখা যায়, কিন্তু চোখে পড়ে না
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯যেসব দেশে পথশিশু বেশি চোখে পড়ে, সেখানকার মানুষগুলোর নিত্যকার অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এই প্রশ্ন একটা সময় হারিয়ে যায়, মলিন হয়ে যায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা শিশুটির জীর্ণ পোশাকের মতো৷ দেখা যায়, কিন্তু ঠিক চোখে পড়ে না৷
তবে মানবিক দিক থেকে এই শিশুদের প্রতি দৃষ্টি না আটকালেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তত এদের দেখা উচিত৷ যেমন, যুক্তির বিচারে একটি দেশে পথশিশু কী সংখ্যক আছে, তা দেশটির দারিদ্র্যেরও মাপকাঠি৷ সহজ হিসেব৷ যেমন, এই সহস্রাব্দের শুরুতে জিম্বাবোয়ের অর্থনীতি চরম ধাক্কা খাবার পর ২০০৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, আগের এক বছরে সে দেশের পথে শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ ভাগ!
তাই একটি দেশে পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে দারিদ্র্য একটি বড় কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সবসময়ই কি তাই? তাহলে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ ব্রাজিলে কেন এত পথশিশু? বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে৷ তাহলে সেই হারে পথশিশুর সংখ্যা কি কমছে?
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘাটলে দেখা যায়, অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ থেকে ১১ লাখ বলা হচ্ছে৷ কোনো সঠিক পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও হিসেব অনেকটা এমনই৷ এর অর্থ সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর গবেষণা উদ্ধৃত করে দু'বছর আগেও স্থানীয় গণমাধ্যম বলেছে, শুধু ঢাকা শহরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে৷
সে গবেষণায় আরো দেখা যায় যে, এই শিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত এবং ১৯ ভাগ গ্রেফতারও হয়েছে৷ ৪১ শতাংশের ঘুমাবার জায়গা নেই, ৮০ ভাগ কাজ করে খায় এবং ৮৪ শতাংশের শীতবস্ত্র নেই৷ এছাড়া এদের অধিকাংশই স্বাস্থ্যসেবা পায় না৷ নানান শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত এরা৷
প্রশ্ন হলো, এই শিশুদের এভাবে অবহেলায় ছেড়ে দেয়াতে কী কী ক্ষতি হয়? অপরাধ বেড়ে যায়৷ এটা একটা বড় ক্ষতি৷ কিন্তু যেই ক্ষতিটা নিয়ে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন আছে, তা হলো, অর্থনৈতিক ক্ষতি৷
এই শিশুরা ঠিকমতো শিক্ষা পেলে এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ পেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়ত, যা থেকে এখন বঞ্চিত হচ্ছে দেশ৷ এটা একটা বিরাট ক্ষতি৷ এর অর্থনৈতিক মূল্য বের করা দরকার৷ তাহলে অন্তত বোঝা যেত, এদের পেছনে সরকারের কতটা ব্যয় করা প্রয়োজন, বা যতটা এখন বরাদ্দ হচ্ছে তা যথেষ্ট কিনা৷
একই সঙ্গে এই অর্থ কোথায় ব্যয় করতে হবে, তা-ও বিবেচনায় রাখা দরকার৷ কারণ, যারা পথশিশু, তাদের জন্য কাজ করা যেমন দরকার, তেমনি কেন এই পথশিশু তৈরি হচ্ছে, সে জায়গাতেও কাজ করতে হবে৷
১৯৮৪ সালে ইউনিসেফ পথশিশুদের তিন ভাগে ভাগ করেছে৷ রাস্তায় শিশু, ঝুঁকির মুখে শিশু ও রাস্তার শিশু৷ রাস্তায় শিশু হলো যাদের ঘর আছে, কিন্তু জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমে আসে৷ আইএলও'র ২৩ বছর আগে করা হিসেবে দেখা যায়, এই শিশুরা গড়ে ঘরের ৩০ ভাগ খরচ জোগায়৷
এছাড়া আছে, শহুরে গরীবদের শিশুরা, যাদের বলা হয়, ঝুঁকির মুখে শিশু৷ এরা কাজ করুক আর না-ই করুক রাস্তায় শিশুদের যে বিরাট সংখ্যা তাতে অবদান রাখে৷ এর বাইরে পরিত্যক্ত, বাড়ি পালিয়ে আসা ও মা-বাবাহীন শিশুরা পড়ে তৃতীয় ভাগে, অর্থাৎ রাস্তার শিশুর তালিকায়৷ এরা সাধারণত ঘরহীন৷
তাই পথশিশুর সংখ্যা কমাতে হলে এসব বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন৷ তিনি আগের মেয়াদে এই শিশুদের নিয়ে কথা বলেছেন৷ পেশাগত কাজে তাঁর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি নিজে শুনেছি যে, তিনি বলছেন, একটি শিশুও যেন ঘরহীন না থাকে৷ সে সময়ে কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছিল৷ সেগুলোর কী অবস্থা?
বাজেটে বরাদ্দ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে৷ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পথশিশুদের নিয়ে প্রকল্প রাখার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু খুব একটা কাজ হয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না৷
বলছি, পথশিশুদের জন্য মায়াকান্না কেঁদে লাভ নেই৷ বছরে দু'তিন বার এদের কয়েকজনকে নিয়ে অনুষ্ঠান করে বাহবা কুড়ানো টুড়ানোর দিন শেষ৷ এখন যেতে হবে সমস্যার গভীরে৷ মানবিক নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা উচিত৷ কারণ, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, আর তার সুবিধা শুধু ধনীরাই পাবেন, তা হতে পারে না৷
আপনারও কি মনে হয়, পথশিশু সংকটের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন? লিখুন নীচের ঘরে৷