দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যুদ্ধের অঙ্গীকার
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে যা আছে
ইশতাহারের ২১টি দফার মধ্যে আছে, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ; সেবামুখী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি; সামষ্টিক অর্থনীতি : উচ্চ আয়, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন; জনবান্ধব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গঠন করা; সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূল; স্থানীয় সরকার ও জনগণের ক্ষমতায়ন; জনসংখ্যায় বয়স কাঠামোর সুবিধাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়ন; অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ প্রকল্প; তরুণ যুবসমাজ : ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ উল্লেখযোগ্য৷ প্রতিটি দফার সঙ্গে গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ কী করেছে, ভবিষ্যতে কী করতে চায় সেগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ নেই৷ এটা খুবই ইতিবাচক৷ পাশাপাশি তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার কথাও বলেছেন৷ এটাও ভালো দিক৷ তিনি টেকসই উন্নয়নের কথা বলেছেন৷ এখন উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে৷ সেখানে বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রেরস্বাধীনতা কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ আমরা দেখেছি, কিছু আইনের কারণে এগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, তিনি নির্বতনমূলক বা পশ্চাতমুখী আইনগুলো সংস্কার করবেন৷ আর দুর্নীতির বিষয়ে যে ঘোষণা এসেছে, সেটা আগেও আমরা ইশতাহারে দেখেছি৷ এটা শুধু ইশতাহারে থাকলেই হবে না৷ এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই৷ আমাদের কিছু প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণ হয়েছে৷ সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে৷ এই কাজগুলো যদি হয়, তাহলে দেশের জন্যই ভালো হবে৷''
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহার ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা৷ দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা নৌকায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে দেবো– এটা আমাদের জাতির কাছে ওয়াদা৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজে এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসী আপনাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি৷ আমি কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরো সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব৷''
ইশতাহার ঘোষণার পর শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আমরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করি৷ আমাদের এবারের অঙ্গীকার, আমরা টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করব৷ এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জনগণ কিছু পায়, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়৷ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাঙ্খিত ক্ষুধা, দারিদ্র, নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব ইনশাল্লাহ৷''
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহার কেমন হলো জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে৷ বিগত দিনের শাসনামলে কী অর্জন ছিল, ভবিষ্যতে কী করতে চায়, সেটার একটা দিকনির্দেশনাও রয়েছে৷ পাশাপাশি রূপকল্প ২০২১ নিয়ে যেমন বলেছেন, তেমনি ২০৪১ ও ২১০০ শতাব্দীতে গিয়ে কী করতে চায়, তারও একটা গাইডলাইন রয়েছে৷ আমি মনে করি, খুবই একটা ইতিবাচক ইশতাহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ৷''
ইশতাহার ঘোষণার সময় শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, ‘‘আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা সাড়ম্বরে পালন করব৷ বাঙালি জাতির এই দুই মাহেন্দ্রক্ষণ সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগই পারবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে দিতে, সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে৷'' ইশতাহার ঘোষণার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজকের বাংলাদেশ আর্থিক দিক থেকে যেমন শক্তিশালী, তেমনি মানসিকতার দিক থেকে অনেক বলীয়ান৷ ছোটখাটো অভিঘাত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আর থামিয়ে রাখতে পারবে না৷ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিয়েছে৷ ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে৷ আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে যেখানে ৫৪৩ মার্কিন ডলার ছিল, সেখানে ১৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদের কাছেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা ভালো দিক৷ কিন্তু গত ১০ বছরে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটাও দেখতে হবে৷ এখানে গণতন্ত্র, রাষ্ট্র ও দল একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে, এটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু সরকারের সমালোচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা কেন হবে৷ এখানে সেটাই হচ্ছে৷ সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা তো যে কেউ করতে পারে৷ গত ৫ বছরে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৮৫ হাজার মামলা হয়েছে৷ এই মামলাগুলোতে সরাসরি ২৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন থেকে ইশতাহার ঘোষণার পরও বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে৷ এখনো অনেক প্রার্থী নির্বাচনি মাঠ বাদ দিয়ে আদালতে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন৷ ফলে ইশতাহারে ভালো ভালো কথা বললে হবে না, মন থেকে বাস্তবায়ন করতে হবে৷ দেশটা কিন্তু স্বাধীন হয়েছিল একটা সাম্যের জন্য৷ মুক্তিযুদ্ধে আমার বহু বন্ধু শহিদ হয়েছে৷ আমি তখন জুনিয়র লেকচারার৷ আমি নিজেও পালিয়ে রক্ষা পেয়েছি৷ এখন দেশ দুই ভাগ হয়ে গেছে৷ আমরা আর তোমরা৷ আমরা মানে আওয়ামী লীগ আর তোমরা মানে বাকি যা আছে৷ আওয়ামী লীগের বাইরেও তো মুক্তিযোদ্ধারা আছে৷ সেটাও তো স্বীকার করতে হবে৷''
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে মানসম্মত সেবা প্রদানের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে৷ সবচেয়ে বড় যে অঙ্গীকার এসেছে, সেটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে৷ সেখানে বলা হয়েছে, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি৷ পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি, যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না৷ দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে৷ আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ৷ নির্বাচনি ইশতেহারে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘যুবসমাজ দেশের মূল্যবান সম্পদ৷ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবসমাজ, যা প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ৷ ‘সোনার বাংলা'র স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধানতম শক্তি হচ্ছে যুবশক্তি৷দেশের এই যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতেরূপান্তরের লক্ষ্য অর্জনে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷''